কেন বড় সংকটের মুখে মার্কিন বিমান নির্মাতা কোম্পানি বোয়িং

যুক্তরাষ্ট্রের বিমান কোম্পানি বোয়িংছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের বিমান কোম্পানি বোয়িংয়ের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। বিশ্বের অন্যতম বড় এই উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানির পরিস্থিতি গত কয়েক বছর ধরেই খারাপ, আর সেই ধারাবাহিকতা চলছে ২০২৪ সালের শুরুতেও। একের পর এক ঘটনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কোম্পানিটি।

সর্বশেষ ঘটনা গত সোমবারের। সেদিন বোয়িংয়ের একটি বিমান মাঝ আকাশ থেকে হঠাৎ সাঁই সাঁই করে নিচে নামতে শুরু করে। পাইলট বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তবে পাইলট নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলেও বেশ কয়েকজন যাত্রী এ ঘটনায় আহত হন।

সিএনএন জানিয়েছে, বিমানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে পাইলট কিছুক্ষণ পর এটি অবতরণ করাতে সক্ষম হন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঠিক কী কারণে অস্ট্রেলিয়া থেকে নিউজিল্যান্ডগামী ৭৮৭ মডেলের এই ড্রিমলাইনারের মাঝ আকাশ থেকে এভাবে পড়ার উপক্রম হলো। বিমানটি ছিল চিলির ল্যাটঅ্যাম এয়ারলাইনসের। তারা বলেছে, বিষয়টি ‘কারিগরি’। বোয়িং বলেছে, তারা আরও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে।

কিন্তু তাদের বর্তমান যে বাস্তবতা, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের সংবাদ কোম্পানির জন্য অনভিপ্রেত।

চলতি বছরের শুরু থেকে একের পর এক খারাপ সংবাদ পাচ্ছে বোয়িং। বলা যায়, শনির দশার সূত্রপাত আলাস্কা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটের প্যানেল খুলে যাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ডোর প্লাগে যে নাট-বল্টু লাগানোর কথা ছিল, সেগুলো ঠিকঠাকমতো লাগানো ছিল না।

এ ঘটনায় কঠিন তদন্তের মুখোমুখি হয় বোয়িং; কমে যায় তাদের ক্রয়াদেশ ও সরবরাহ। এত সব সংকটের মধ্যে জানা গেল, ফৌজদারি তদন্তের মুখে পড়তে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ঘটনায় চলতি বছর বোয়িংয়ের শেয়ারের মূল্য এক-চতুর্থাংশের বেশি কমে গেছে। ফলে কোম্পানিটির বাজারমূল্য কমেছে চার হাজার কোটি ডলার।

ক্ষতির বহর এখানেই হয়তো শেষ হবে না; সর্বশেষ এ ঘটনায় তাদের বিমানের ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার পাশাপাশি জরিমানার মুখে পড়তে হতে পারে।

পাঁচ-ছয় বছর ধরেই বোয়িংয়ের অবস্থা ভালো নয়। কোম্পানিটির ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে আছে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সংঘটিত বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজের দুটি দুর্ঘটনা। লায়ন এয়ার ও ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের ওই দুর্ঘটনার তদন্ত নিষ্পত্তি করতে ২০২১ সালে বোয়িং ২৪ কোটি ৪০ লাখ জরিমানাসহ ২৫০ কোটি ডলার দিতে রাজি হয়। তখন ফ্লাইট-কন্ট্রোল সিস্টেমের ত্রুটি বিষয়ে দুই কর্মচারীকে দায়ী করা হয়েছিল। এবারের তদন্তে ওই ঘটনাগুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এমনকি বোয়িং উড্ডয়নের নথিও যথাযথভাবে সংরক্ষণ করছে না বলে জানা গেছে। সম্প্রতি কংগ্রেসকে পাঠানো চিঠিতে বোয়িং স্বীকার করেছে, আলাস্কা এয়ারলাইনসের বিমানের দরজার প্যানেল লাগানোর রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বোয়িংয়ের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট জিয়াদ ওজাকলি ওই চিঠিতে লেখেন, তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে; কিন্তু সে ধরনের নথি পাওয়া যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বলেছে, বোয়িংয়ের ঘাটতি কেবল নথিপত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সংস্থাটির প্রশাসক মাইক হুইটেকার সিএনএনকে বলেছেন, বোয়িংয়ের উৎপাদন ও সংযোজনপ্রক্রিয়ায় গলদ আছে, যেমন কাজের আদেশ দেওয়া ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার। তিনি বলেছেন, ঠিক জায়গায় ঠিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে, বোয়িংকে এটা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি বোয়িংয়ের সামগ্রিক পরিচালনা পদ্ধতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তায় গুরুত্বারোপ করেন।

গত বছর বেশ কয়েকবার বোয়িংয়ের তৈরি বিমানের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বিভিন্ন মহলে। এয়ারবাসের সঙ্গে টেক্কা দিতে ২০২৩ সালের অক্টোবরে বোয়িংয়ের প্রধান নির্বাহী ডেভিড ক্যালহোন জানান, প্রতি মাসে ম্যাক্স মডেলের ৩৮টি বিমান তৈরি করা হবে। এরপর বোয়িংয়ের পক্ষ থেকে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে উৎপাদন সক্ষমতা আরও বাড়ানোর কথা বলা হয়।

সাম্প্রতিক একাধিক দুর্ঘটনার পর গত মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে ২৭টি উড়োজাহাজ সরবরাহ করেছে বোয়িং; গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের পর যা সর্বনিম্ন। এর মধ্যে বোয়িং ম্যাক্স উড়োজাহাজ বিক্রি করেছে মাত্র তিনটি। আরও তিনটির ক্রয়াদেশ ছিল; কিন্তু সেগুলো বাতিল হয়েছে।

ল্যাটঅ্যাম ফ্লাইটের ঘটনার পর সোমবার বোয়িংয়ের শেয়ারের দাম ৩ শতাংশ কমেছে। এরপর মঙ্গলবার শেয়ারের দাম আরও সাড়ে ৪ শতাংশ কমে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ কোম্পানির মধ্যে কেবল টেসলার শেয়ার এর চেয়ে খারাপ করেছিল।

তবে ২০২৪ সালে বোয়িংয়ের সূচনা শুধু শেয়ারের দামের দিক থেকে বিচার করলে চলবে না। নতুন বছর তারা শুরু করেছে বদনাম নিয়ে। কিন্তু যেভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটছে এবং তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে করে কোম্পানির ওপর বিভিন্ন এয়ারলাইনস, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও যাত্রীদের আস্থা ফিরে পাওয়া বোয়িংয়ের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠছে।