মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ধেয়ে আসছে মন্দা

  • গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং অক্টোবরে যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১১ দশমিক ১ শতাংশ—যা উভয় দেশে চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

  • মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। এতে ব্যাংক সুদ বাড়বে এবং মানুষ নিতান্ত জরুরি না হলে ঋণ নেবে না।

‘মন্দা’ এমন একটি ভীতিকর শব্দ এবং এই শব্দের মধ্যে এমন একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুরবস্থার দ্যোতনা নিহিত থাকে
অলঙ্করণ: আরাফাত করিম

চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে কোভিডের পর আবার শুরু হয় সরবরাহ–সংকট। এসব কারণে ২০২২ সালে বিশ্বের উন্নত দেশসহ অধিকাংশ দেশেই মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। নাভিশ্বাস উঠে যায় সাধারণ মানুষের। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশে দেশে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার পরিণামে মন্দা ধেয়ে আসছে।

বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার চার দশকের রেকর্ড ভেঙেছে এবার। যুক্তরাজ্যেও তাই। গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের  মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং অক্টোবরে যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১১ দশমিক ১ শতাংশ—যা উভয় দেশে চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। নিউজিল্যান্ডের মতো দেশের মূল্যস্ফীতির হারও ২২ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। গত জুনে দেশটির মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হারে সবাইকে ছাড়িয়ে যায় তুরস্ক। গত জুনে দেশটির মূল্যস্ফীতি ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশে উঠে যায়, যা ১৯৯৮ সালের পর সর্বোচ্চ।

মূল্যস্ফীতিকে নীরব ঘাতক হিসেবে আখ্যা দেন অর্থনীতিবিদেরা। আগের বছর বা মাসের সঙ্গে অথবা নির্দিষ্ট সময়ের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে খাদ্য, কাপড়, পোশাক, বাড়ি, সেবা ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদানের মূল্যবৃদ্ধির যে পার্থক্য যাচাই করা হয়, তা-ই মূল্যস্ফীতি। যেমন কোনো পণ্যের দাম ২০২০ সালে ছিল ৫ টাকা, পরবর্তী বছর তা হয়েছে ৬ টাকা। অর্থাৎ সেই পণ্যের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। তবে সব পণ্যের দাম একভাবে বাড়ে না। বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির তথ্য একটি পদ্ধতির মাধ্যমে গড় করে মূল্যস্ফীতির হার বের করা হয়। মোদ্দাকথা হলো, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়।

মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে। তা লাগামছাড়া হলে সমাজে দারিদ্র্য বেড়ে যায়।

বিশ্লেষকেরা বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে দেশে জীবনযাত্রার সংকট গভীর হয়েছে। বিশেষ করে করোনার প্রভাব কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে খাদ্য, জ্বালানিসহ পণ্যসামগ্রীর দাম ও জাহাজভাড়া বৃদ্ধি পাওয়া এবং সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের জেরে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস, তেল ও খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছে। আমদানিনির্ভর দেশগুলো এতে বেশি বেকায়দায় পড়েছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা বিদেশি মুদ্রার সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশসহ অনেক দেশ আমদানি কমাতে বাধ্য হয়েছে।

বাস্তবতা হলো, মূল্যস্ফীতির সূচক দেশে দেশে রেকর্ড উচ্চতায় ওঠার কারণে যুদ্ধের প্রথম তিন মাসেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সব মিলিয়ে মোট ৭ কোটি ১০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে বলে জানায় ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি)। এই সংখ্যা বছর শেষে কত দাঁড়াবে, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও বলা যায়, অনেক মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। এতে ২০২০ সালের পর আবার ব্যাহত হবে দারিদ্র্যবিমোচন।

মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। ধারণা হচ্ছে, এতে ব্যাংক সুদ বাড়বে এবং মানুষ নিতান্ত জরুরি না হলে ঋণ নেবে না। পরিণামে সমাজে অর্থের প্রবাহ কমে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। দেশে দেশে ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদ বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতির হার বছর শেষে কমতে শুরু করেছে।

এদিকে শুধু মূল্যস্ফীতি যে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে তা নয়, একই সঙ্গে নীতি সুদহারও চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠেছে। এতে দেশে দেশে মন্দার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সে জন্য ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক কর্মকর্তা ও মর্গ্যান স্ট্যানলির বৈশ্বিক প্রধান অর্থনীতিবিদ সেথ কারপেন্টার বলেন, এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। তাঁর মতে, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব। সে জন্য তাদের এখন কড়া কড়া কথা বলা ঠিক হবে না।

নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎস অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন। প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের প্রবন্ধে তাঁর মত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে গণহারে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে, তা ‘ওভার ডোজ’ হয়ে যাচ্ছে। চাহিদা হ্রাস ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি করে সরবরাহব্যবস্থার ব্যাঘাত ঘটানো কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, নীতি সুদহার অব্যাহতভাবে বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে, কিন্তু এতে নিম্ন আয় ও সাধারণ মানুষের জীবন নিঃশেষ হয়ে যাবে।

স্টিগলিৎসের কথাই এখন সত্যি হচ্ছে। নীতি সুদহার বৃদ্ধির জেরে বিশ্বে মন্দার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।