চীন পেল বিশাল কাজ, নেপাল পেল ঋণের বোঝা ও দামি এক বিমানবন্দর
নেপালের পর্যটনস্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত জায়গা হচ্ছে পোখারা। সেই গত শতকের সত্তরের দশক থেকে পোখারায় একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের কথা ভাবছিল নেপাল। কিন্তু অর্থের অভাব, রাজনৈতিক ডামাডোলসহ নানা কারণে সেই বিমানবন্দর তারা বানাতে পারেনি। তবে শেষ পর্যন্ত চীনের অর্থায়নে তারা সেই বিমানবন্দর নির্মাণ করে।
কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিমানবন্দর নির্মাণে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে; এমনকি ভূপ্রাকৃতিক যেসব পরীক্ষা করা জরুরি ছিল, সেগুলোও করা হয়নি। সে কারণে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের শিরোনাম করা করা হয়েছে এ রকম: ‘চীন পেল বিশাল কাজ, নেপাল পেল ঋণ ও দামি এক বিমানবন্দর’। সেই সঙ্গে এই বিমানবন্দর থেকে তেমন একটা আয়ও করতে পারছে না নেপাল।
এরপর বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয়ে গেলে চীন তাকে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা অঞ্চলে ও পথ উদ্যোগের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে, যদিও নেপাল খুব মোলায়েমভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে। পরিণতিতে এই বিমানবন্দর এখন চীন ও ভারতের কূটনৈতিক যুদ্ধের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
চলতি সপ্তাহে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ১০ বছর পূর্তি উৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে। নেপালসহ আরও অনেক দেশ সেই উৎসবে যোগ দিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, চীনের এসব বিদেশি উন্নয়ন প্রকল্প অধিক ব্যয় ও নিম্নমানের জন্য সমালোচিত হচ্ছে। এসব প্রকল্পের কারণে ঋণগ্রহীতা দেশগুলো ঋণের বোঝায় চাপা পড়ছে। নেপালের পোখারা বিমানবন্দরকে চীনের এই উন্নয়ন মডেলের একটি আদর্শ প্রতিরূপ হিসেবে উপস্থাপন করেছে নিউইয়র্ক টাইমস, যেসব প্রকল্পের মধ্য দিয়ে চীনের কোম্পানি টাকা বানাচ্ছে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর আদতে ক্ষতি হচ্ছে।
পোখারার এই বিমানবন্দর বানিয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিনেমাকের প্রকৌশল সংস্থা চায়না সিএএমসি। তারা ভবনের সব উপাদান ও মাটি সরানোর যন্ত্রপাতি চীন থেকে এনেছিল। বিমানবন্দরের ডিজাইনও চীনের ডিজাইন, সেখানে যত ধরনের নিরাপত্তা ও শিল্পপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তার সবই চীনের। নেপালে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত চেন সং বলেছেন, এই বিমানবন্দর চীনের প্রকৌশল মানের মুক্ত প্রকাশ।
নিউইয়র্ক টাইমস তাদের নিজস্ব তদন্ত ও বিমানবন্দরে নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত ছয় ব্যক্তির সাক্ষাৎকার আর শত শত পৃষ্ঠা সরকারি নথি বিশ্লেষণ করে দেখেছে, চীনের সিএএমসি এই বিমানবন্দর নির্মাণকাজের শর্ত নিজেদের মতো করে তৈরি করে নিয়েছে, এমনকি নেপাল সরকারের তত্ত্বাবধানকেও তারা পাত্তা দেয়নি।
এ পরিস্থিতিতে নেপাল এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নিয়ে বিপদে পড়েছে। একদিকে এ বিমানবন্দর নির্মাণে ব্যয় অনেক বেশি হয়েছে, আরেক দিকে বিমানবন্দরের এত পরিমাণে যাত্রী আসছে না যে তার পক্ষে চীনের ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব।
২০ বছরের চুক্তি
পোখারার সৌন্দর্য অপরূপ। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই শহরে যেতে পর্যটকেরা ভুল করেন না। অর্থাৎ যাঁরা নেপাল সফরে যান, তাঁরা অবশ্যই পোখারা যাওয়ার চেষ্টা করেন। আকাশ পরিষ্কার থাকলে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ১০টি পর্বত এই শহর থেকে দেখা যায়।
২০১২ সালে চীন এই বিমানবন্দর নির্মাণে ঋণ দিতে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজি হয়। কিন্তু তার এক বছর আগে সিএএমসির প্রস্তাবে সমর্থন দিতে চীনের অর্থমন্ত্রী এক সমঝোতা স্মারকে সই করেন, যদিও দরপত্রের প্রক্রিয়া তখনো শুরুই হয়নি।
এই প্রক্রিয়ায় শুধু চীনের কোম্পানিগুলো দরপত্রে অংশগ্রহণের অনুমতি পায়।
সিএএমসি ৩০৫ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি ৫০ লাখ ডলারে এই বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ পায়, যদিও নেপাল সরকারের প্রাথমিক অনুমান ছিল, খরচ হবে এর অর্ধেক। ফলে দ্বিগুণ দামে চীনের কোম্পানিকে কাজ দেওয়ায় নেপালের অনেক রাজনীতিক খেপে যান। তাঁদের অভিযোগ, এই দরপত্র প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি করা হয়েছে। এরপর সিএএমসি দর ৩০ শতাংশ কমিয়ে ২১ কোটি ৬০ লাখ ডলারে নামিয়ে আনে।
এরপর নেপাল ও চীন ২০১৬ সালে এই বিমানবন্দর নির্মাণে ২০ বছরের চুক্তি সই করে। যে অর্থ ব্যয় হবে, তার এক-চতুর্থাংশ বিনা সুদে ঋণ হিসেবে নেবে দেশটি; বাকি অর্থ চীনের এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ২ শতাংশ সুদে ঋণ নেওয়া হবে। নেপাল ২০২৬ সাল থেকে এই ঋণ পরিশোধ শুরু করার অঙ্গীকার করে।
২০১৭ সাল থেকে বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ শুরু হয়।
নেপালি পর্যবেক্ষক
প্রাথমিক বাজেটে নেপাল সরকারের জন্য ২৮ লাখ ডলার আলাদা করে রাখা হয়েছিল পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার জন্য। সিএমএসি নির্মাণকাজে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছে কি না, এটা দেখাই পরামর্শকের কাজ। প্রকল্প শুরু হওয়ার পর নেপাল সরকার ও সিএমএসি সেই বরাদ্দ কমিয়ে ১০ হাজার ডলারে নামিয়ে আনে; বাকি অর্থ তারা অন্য খাতে ব্যয়ের জন্য নিয়ে যায়।
২০১৮ সালে নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নির্মাণকাজের তদারকির জন্য মুরারি গৌতম নামের এক স্বাধীন পরামর্শককে নিয়োগ দেয়। তিনি এর আগে সৌদি আরব ও কাতারে কাজ করছেন—কাতার বিশ্বকাপের ফুটবল স্টেডিয়াম নির্মাণেও তিনি কাজ করেছেন।
কিন্তু কাজ শুরু করেই মুরারি গৌতম বিপৎসংকেত দেখতে পান। এ ধরনের বড় প্রকল্পে যেখানে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের থাকার কথা ছিল, সেখানে তিনি দেখেন যে বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ পদে কলেজ পাস করা স্নাতকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না বললেই চলে।
মুরারি গৌতম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার আগেই সিএএমসি কাজ শুরু করে দেয়। শুধু তা–ই নয়, সিএএমসির কাজ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করছিল না। ৮ হাজার ২০০ ফুট রানওয়ের জন্য সিএএমসি মাটি ভরাট শুরু করে; কিন্তু এমন কোনো নথি খুঁজে পাওয়া যায় না যে তারা এই মাটি ভরাটের আগে মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করেছিল।
মুরারি গৌতম আরও বলেন, নেপালের পক্ষ থেকে কেউ জানে না, রানওয়ের ভিত কীভাবে তৈরি করা হয়েছে। মাটির যথাযথ ঘনত্ব না থাকলে রানওয়ে উঁচুনিচু হয়ে যেতে পারে বা সেখানে অনেক ফাটল তৈরি হতে পারে।
এখানেই শেষ নয়, পোখারার দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টি ও বিমানবন্দর অঞ্চলের পানি নামার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা আমলে না নিয়ে বিমানবন্দরের পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নির্মাণ করা হয়েছে। মুরারি গৌতমের ধারণা, ভারী বৃষ্টি হলে বিমানবন্দরে পানি জমে যেতে পারে।
নথিপত্রের বিষয়ে মুরারি গৌতম সিএএমসি কর্তৃপক্ষকে চাপাচাপি করলে তারা পরামর্শককে এড়িয়ে সরাসরি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে, যাদের নির্মাণকাজ সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে সিএএমসি এক চিঠিতে জানায়, নেপালি পরামর্শকের ‘অপ্রয়োজনীয় সংশোধনের’ কারণে নির্মাণকাজ বিলম্বিত হতে পারে।
সেই চিঠির পরই মুরারি গৌতম হতাশা থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি বলেন, ঠিকাদারেরা মুনাফা বাড়াতে তদারকি এড়ানোর চেষ্টা করেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু নেপাল সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের তদারকি নেই, এটা তাঁকে বিস্মিত করেছে।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিমানবন্দর উদ্বোধন করেন।
কিন্তু চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে এর নাম জড়িয়ে যাওয়া নেপালের জন্য কাল হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় নেপাল ভারতের চক্ষুশূল হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো ভারতীয় বিমান সংস্থা পোখারাগামী বিমান চালু করেনি। সে কারণে নেপালও বিপদে পড়েছে।
নেপালের বৃহত্তম বিমান সংস্থা বুদ্ধ এয়ার উত্তর ভারতের বরানসি থেকে পোখারা পর্যন্ত সপ্তাহে দুটি উড়ানের প্রস্তাব দিয়েছিল; এরপর তারা দেরাদুন ও দিল্লি থেকে ফ্লাইট চালুর প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভারতের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সে প্রস্তাব অনুমোদন করেনি।
কিন্তু সিএএমসি ২০১৪ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে বলেছিল, এই বিমানবন্দর নিজের মুনাফা থেকেই ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। তাদের অনুমান ছিল, ২০২৫ সাল থেকে বছরে ২ লাখ ৮০ হাজার আন্তর্জাতিক যাত্রী এই বিমানবন্দর ব্যবহার করবেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক বিমান এই বন্দরে আসেনি।
এ পরিস্থিতিতে নেপাল সরকার চীনের কাছে এই ঋণকে অনুদানে রূপান্তরিত করার অনুরোধ করেছে বলে নেপালের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে নেপালের প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে গেলে উভয় দেশ এক যৌথ বিবৃতিতে এই বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় ‘সন্তুষ্টি’ প্রকাশ করে। তবে ঋণ অনুদান হয়ে যাবে কি না, বিবৃতিতে তা অবশ্য বলা হয়নি।