যেভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ইরানের তেল যাচ্ছে সারা বিশ্বে

জ্বালানি তেল
রয়টার্স

ইরানের তেলের বিক্রিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আছে। তা সত্ত্বেও ইরানের তেল বিক্রি থেমে নেই, বিভিন্নভাবে সেই নিষেধাজ্ঞার ফাঁক গলে তারা বিভিন্ন দেশের কাছে তেল বিক্রি করে। যেসব জাহাজ এই নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশের তেল পরিবহন করে, তাদের বলা হয় ডার্ক ফ্লিট। দ্য ইকোনমিস্টের এক সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে তেল সরবরাহের যে নেটওয়ার্ক ইরান গড়ে তুলেছে, তা ভাঙতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেগ পেতে হবে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দুবাইভিত্তিক এক অপরিচিত কোম্পানি ডিলরো ১৮ বছরের পুরোনো তেলের ট্যাংকার ওশান কাপাল কিনে নেয়। এরপর পানামার পতাকাবাহী এ জাহাজের এই নতুন নামকরণ হয় অ্যাবানডান্স ৩। এর মধ্য দিয়ে জাহাজটির কাজও বদলে যায়। এপ্রিলে এ জাহাজ ইরানের তেল নিয়ে উত্তর চীনের দংজিয়াকুতে পৌঁছায়। সেপ্টেম্বরে জাহাজটি আবার ইরানের তেল নিয়ে চীনের বন্দরে ভেড়ে।

জাহাজটি এখন মালয়েশিয়ায় অপেক্ষা করছে। হতে পারে, সেখান থেকে আরেকটি ইরানি তেলবাহী কার্গো থেকে তেল নিয়ে আবার ছুটবে সে। নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশের তেল পরিবহনে যে ডার্ক ফ্লিট গড়ে উঠেছে, এটি তার নবতম সংযোজন। ২০২০ সালে ইরান এ প্রক্রিয়ায় দিনে ৩ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল তেল বিক্রি করত, এখন যা ১৪ লাখ ব্যারেলে উত্তীর্ণ হয়েছে।

ইরানের তেল পরিবহনে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র সেই নিষেধাজ্ঞার বাঁধন কিছুটা আলগা করে। লক্ষ্য ছিল দুটি—প্রথমত, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির রাশ টেনে ধরা; দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তেলের দাম হ্রাস করা। ফলে ইরান-সম্পর্কিত কালো তালিকায় থাকা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে আসে।

তবে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর দৃশ্যপট বদলে যায়। হামাস বাহিনীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে ইরান। এ কারণে বাইডেন প্রশাসন ইরানের নিষেধাজ্ঞার যে বাঁধন কিছুটা আলগা করেছিল, সেগুলো আবার কঠোর করার চাপে পড়েছে। ইরান তেল বিক্রি করে লাভবান হলে হামাসেরই যে আখেরে লাভ, সে কারণে এ চাপ। তবে এ নিয়ে বাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তেমন উত্তেজনা নেই। সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৯৭ ডলার, এখন তা ৯০ ডলারে নেমেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইরানের তেলে আবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে বাজার চড়ে যাবে কি না।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হলেও পরবর্তী সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় আবারও নিষেধাজ্ঞা জোরালো করা হয়। ইকোনমিস্ট বলছে, সেই সময় থেকে ইরানের এই তেল সরবরাহের নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী হয়। ইরানের তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে চীন। সেই তেলের আবার বেশির ভাগ কিনছে ছোট ছোট পরিশোধনাগারগুলো। চীন ইরান থেকে যত তেল কেনে, তার ৯৫ শতাংশই যায় এই সব ছোট ছোট তেল পরিশোধনাগারগুলোতে। ইরানের তেল বিশ্ববাজারের চেয়ে ব্যারেলপ্রতি ১০-১২ ডলার ছাড়ে পাওয়া যায়, যেখানে রাশিয়ার তেলে ছাড় পাওয়া পায় ব্যারেলে পাঁচ ডলার। নিষেধাজ্ঞার কবল থেকে বাঁচতে চীনের এই ছোট পরিশোধনাগারগুলো চীনা মুদ্রায় লেনদেন করে, ডলারে নয়। এ কৌশলের মধ্য দিয়ে ইরান নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল কেনাবেচা করতে পারছে।

চীনের সংশ্লিষ্টতা

এই সরবরাহব্যবস্থার শেষ কাজটা করে অখ্যাত মধ্যস্বত্বভোগীরা। জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান কেপলারের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে ১০২টি অতি বৃহৎ জাহাজ ইরানের তেল পরিবহন করেছে। গত বছর এগুলোর মধ্যে ৪২টি তেল পরিবহনের কাজে ছিল না এবং ২৭টি জাহাজের গোপন তৎপরতার ইতিহাস নেই। বছরে হাতে গোনা কয়েকবার তেল পরিবহন করে তারা। কারণ এ ধরনের গোপন অভিযানের ভাড়া অনেক বেশি।

এসব জাহাজ কোম্পানির মালিকানাও রহস্যাবৃত। চীন, ভিয়েতনাম ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে নিবন্ধিত শেল কোম্পানির হাতে এদের মালিকানা। মার্কিন রাজস্ব বিভাগের কাছে যেসব নাম আছে, তার অধিকাংশের নাম চীনা। এর অর্থ হলো, এগুলোর মালিকেরা চীনের মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দা। চীনের বেশ কটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানও এ তালিকায় আছে। তবে সেগুলো ‘বলির পাঁঠা’র মতো, শুধু ইরানের তেল আমদানি করাই এদের কাজ। ইরান সরকার এ তেল পরিবহনের বিমা দেয়।

এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রশাসনের অনেকেই এ ব্যবসা বন্ধ করতে চান, যদিও নতুন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সম্ভাবনা কম। বিদ্যমান যেসব নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেগুলোর পরিসর যথেষ্ট বড়। তবে সেগুলো প্রয়োগে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতে কী, এই ডার্ক ফ্লিটকে কি সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া সম্ভব বা যারা এই ব্যবসা করছে, তাদের?

এই ব্যবসা বন্ধ করার ক্ষেত্রে নানা চ্যালেঞ্জ আছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় তেল করপোরেশন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বা মার্কিন ডলারে ব্যবসা করছে না। তাই যত নিষেধাজ্ঞাই আসুক না কেন, তাদের একধরনের সুরক্ষা আছে।

অন্যদিকে চীনের যে ছোট ছোট পরিশোধনাগারগুলো ইরানের তেল কিনছে, সেগুলোর ওপর খড়্গহস্ত হতে পারে কেবল চীন, কিন্তু তারা সেটা কেন করবে। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্বত্বভোগীদের ধরার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু এ মুহূর্তে রাশিয়া ও ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর তাদের নিষেধাজ্ঞা আছে। ফলে চোরাচালান ঠেকাতে হলে সবার বেলায় একই ব্যবস্থা নিতে হবে, কিন্তু সেই সক্ষমতা তার কমে গেছে।

সে কারণে যত বাধাবিপত্তি আসুক না কেন, তার স্থায়িত্ব তিন মাস বা তার চেয়ে খুব একটা বেশি হবে না।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রাইস্টাড এনার্জির হিসাব, ইরানের তেল পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হলে প্রাথমিকভাবে দৈনিক তিন লাখ ব্যারেল তেলের জোগান কমে যাবে, বিশ্ববাজারের মোট চাহিদার যা শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। এতে অবশ্য তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি চার থেকে পাঁচ ডলার বেড়ে যেতে পারে।

কঠোর ব্যবস্থা কাজ করে না কেন

পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয়, অর্থাৎ রাজনৈতিক উত্তেজনা যদি বেড়ে যায় এবং উপসাগরের দেশগুলো ইরানের তেল পরিবহনে যারা সহায়তা করে, তাদের ওপর হামলে পড়ে, তাহলে বিশ্ববাজার থেকে দৈনিক আরও চার লাখ ব্যারেল ইরানি তেলের জোগান হারিয়ে যাবে। সেটা অবশ্য বড় ধাক্কা হয়ে আসবে। ধারণা করা হচ্ছে, তাতে তেলের দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

তবে সেটা হবে সাময়িক। কারণ, ওই পরিস্থিতিতে ইরানের প্রতিবেশী দেশগুলো তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেবে। ওপেক চাইলে তেলের উৎপাদন দিনে ৫৫ লাখ ব্যারেল বাড়িয়ে দিতে পারে। সৌদি আরব একাই ইরানের তেলের ঘাটতি পূরণ করতে পারে।

সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা গেছে, নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করার কারণে যুক্তরাষ্ট্র কোনো কোম্পানির ওপর খড়্গহস্ত হলে তারা দ্রুত সেই ব্যবসা ছেড়ে দেয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই শূন্যতা পূরণ করার জন্য আরও অনেক কোম্পানি চলে আসে। ইরানের আরেকটি সুবিধা হলো, তাদের ওপর কেবল মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আছে, যেখানে রাশিয়ার ওপর সমগ্র পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা আছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র চাইলে সমুদ্রে ইরানের জাহাজ আটকে দিতে পারে। কিন্তু তা করতে গেলে বিপুল খরচ প্রয়োজন, সেই সঙ্গে আইনি জটিলতা ও প্রতিশোধের হুমকি আছেই।

তবে চলতি মাসে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করার কারণে দুটি তেলবাহী ট্যাংকার চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে ভেনেজুয়েলার ওপর নিষেধাজ্ঞার বাঁধন কিছুটা শিথিল করেছে এই আশঙ্কা থেকে যে কোনো কারণে ইরানের তেল রপ্তানি কমে যেতে পারে। তা সত্ত্বেও এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র যত ব্যবস্থাই নিক না কেন, ইরানের সরবরাহব্যবস্থা তা পাশ কাটানোর মতো যথেষ্ট নমনীয়।