২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

চীনা পণ্যে শুল্ক বাড়ার সুযোগ নিচ্ছে ভিয়েতনাম, তবে আসতে পারে মার্কিন শাস্তি

ছবি: এএফপি

চীন থেকে আমদানি কমাতে চেষ্টা আরও জোরদার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর অংশ হিসেবে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বা ট্যারিফ বাড়িয়েছে দেশটি। এর পরপরই ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তবে বাণিজ্য পরিসংখ্যান বলছে, ভিয়েতনাম আবার তার রপ্তানি পণ্য তৈরি করতে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করছে চীন থেকেই।

রয়টার্স জানিয়েছে, চীন-ভিয়েতনাম-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ত্রিমুখী বাণিজ্য নতুন ধরনের বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার জন্ম দিয়েছে। গত বছর ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে ১০ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত করেছে। ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ওপর বড় ধরনের ট্যারিফ আরোপ শুরু করার পর যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের রপ্তানি আড়াই গুণ বেড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করে যাদের সবচেয়ে বেশি উদ্বৃত্ত হয়, ভিয়েতনাম সেই তালিকায় চতুর্থ স্থানে আছে। তাদের ওপর আছে চীন, মেক্সিকো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে রয়টার্স দেখেছে যে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের রপ্তানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চীন থেকে দেশটির আমদানি বিপুলভাবে বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই তিন দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে বলে দেখা গেছে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বিএমআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড্যারেন টে বলেন, চীন থেকে ভিয়েতনামের আমদানির সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের রপ্তানি বেড়েছে। এর ফলে মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করতে পারেন যে চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ট্যারিফ আরোপ করার পর এই শুল্ক এড়াতে চীনের কোম্পানিগুলো ভিয়েতনামকে ব্যবহার করছে। তিনি মনে করেন, মার্কিন নির্বাচনের পর ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা হতে পারে।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ১১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করেছে। ২০১৮ সাল চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমদানির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। চীন-মার্কিন উত্তেজনার ফলে তৈরি হওয়া ঝুঁকি কমাতে অনেক আমেরিকান কোম্পানি ও ব্যবসায়ী ভিয়েতনামকে বিকল্প হিসেবে বেছে নেন।

ভিয়েতনামের পণ্য, চীনের কাঁচামাল

২০১৮ সালের পর চীন থেকে আমেরিকার পণ্য আমদানি ১১ হাজার কোটি ডলার কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই সময় ডলারের হিসেবে ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন আমদানি যতটা বেড়েছে, তা চীনা পণ্যের আমদানি হ্রাসের অর্ধেকের মতো।

ভিয়েতনামের আরএমআইটি ইউনিভার্সিটির সাপ্লাই চেইন বিশেষজ্ঞ নগুয়েন হাং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান প্রধান পণ্য যেমন পোশাক ও ইলেকট্রিক সরঞ্জামের বাজার চীন যতটা হারিয়েছে, তার ৬০ শতাংশের বেশি দখল করেছে ভিয়েতনাম। তবে চীনের কাঁচামালের গুরুত্ব কোনো অংশেই কমেনি। ভিয়েতনাম যত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে, তার বেশির ভাগের কাঁচামাল ও পণ্য তৈরির সরঞ্জাম আসে চীন থেকে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে ভিয়েতনাম যত ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানি করেছে, তার ৮০ শতাংশ যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয়েছিল। ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্র এই পণ্য বেশি আমদানি করে।

ভিয়েতনামের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশটির আমদানির এক-তৃতীয়াংশ আসে চীন থেকে। এই আমদানির বেশির ভাগই ইলেকট্রনিকস ও কেবল্‌ সরঞ্জাম।

যুক্তরাষ্ট্রে এখনো মূল্যস্ফীতি বেশি। ভিয়েতনাম যে বিপুল বাণিজ্য উদ্বৃত্ত উপভোগ করছে, হোয়াইট হাউস সে বিষয়ে কিছু বলছে না। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নভেম্বরের মার্কিন নির্বাচনের পর এই অবস্থা পাল্টে যেতে পারে।

ভিয়েতনামে এডিবির মুখ্য অর্থনীতিবিদ নগুয়েন হাং বলেন, নির্বাচনের পর সম্ভাব্য একটি পরিস্থিতি এমন হতে পারে, যেই জিতুন না কেন, ভিয়েতনামের ব্যাপারে নীতির পরিবর্তন হবে। তবে তিনি মনে করেন, ভিয়েতনামের পণ্যে ট্যারিফ আরোপ করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি খরচ বাড়বে।

বাণিজ্য ভারসাম্যের বিষয়ে হ্যানয়ে মার্কিন দূতাবাস কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। মন্তব্যের জন্য ভিয়েতনামের পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কথা বলতে রাজি হয়নি। আর চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও মন্তব্যের জন্য জানানো অনুরোধে দ্রুত সাড়া দেয়নি।

সুতা ও প্যানেল

চীন-ভিয়েতনাম-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ত্রিমুখী বাণিজ্যের একটি বিশেষ দিক হলো, ভিয়েতনামের উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। অনেক কোম্পানি চীন থেকে ভিয়েতনামে কারখানা সরিয়ে এনেছে। এর মধ্যে অনেকটি চীনা কোম্পানি, যারা উত্তর ভিয়েতনামে কারখানা করেছে কিন্তু মালামাল আনছে চীন থেকে।

আবার অনেক পণ্য আছে, যাতে ভিয়েতনামে কোনো মূল্য সংযোজন না হলেও ‘ভিয়েতনামে তৈরি’ হিসেবে লেবেল লাগানো হচ্ছে। গত বছর সোলার প্যানেলের ওপর তদন্ত চালিয়ে মার্কিন বাণিজ্য বিভাগ এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল। অ্যালুমিনিয়াম ও সোলার প্যানেলে অন্যায্য ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, এমন অভিযোগ মার্কিনরা এখন খতিয়ে দেখছে।

ভিয়েতনামের অন্য যে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের নজরে রয়েছে, তাহলো জিনজিয়ানের সঙ্গে হ্যানয়ের সংযোগ। চীনের ওই অঞ্চলের যেকোনো পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি নিষিদ্ধ। সংখ্যালঘু উইঘুরদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে এই অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই জিনজিয়ানই হলো চীনা তুলার প্রধান উৎস। পলিসিলিকন হলো আরেকটি কাঁচামাল, যা জিনজিয়ানে পাওয়া যায়। এটি সোলার প্যানেল তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। তুলা আর পলিসিলিকন আবার ভিয়েতনামের শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল। ভিয়েতনাম গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে যত পণ্য রপ্তানি করেছে, তার ৯ শতাংশই ছিল তুলার তৈরি কাপড় ও সোলার প্যানেল।

মার্কিন কাস্টমস পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জোরপূর্বক উইঘুর শ্রম ব্যবহার করে পণ্য তৈরি করা হয়েছে, এমন ঝুঁকির কারণে যুক্তরাষ্ট্র গত বছর যত পণ্য নিজের দেশে ঢুকতে দেয়নি, তার একটি বড় অংশই ছিল ভিয়েতনামে তৈরি। এরপর চীন থেকে ভিয়েতনামের তুলা আমদানি ১১ শতাংশ কমে যায়। তবে এরপরও ২০১৮ সালের তুলনায় চীন থেকে ভিয়েতনামের তুলা আমদানি দ্বিগুণ হয়েছে।

চীন একই সঙ্গে গত বছর ১৫০ কোটি ডলারের পোশাক ভিয়েতনামে রপ্তানি করেছে। ২০২২ সালে এই রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৩০ কোটি ডলার। অন্যদিকে, গত বছর ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন পোশাক আমদানি ২৫ শতাংশ কমে ৫৩০ কোটি ডলার হয়েছে। যে ডেটার ভিত্তিতে এই তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে হয়তো সব ধরনের পোশাকের রপ্তানি পরিসংখান অন্তভুক্ত করা হয়নি।

আরএমআইটি ইউনিভার্সিটির সাপ্লাই চেইন বিশেষজ্ঞ নগুয়েন হাং বলেন, ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন আমদানি এমন সময় কমেছে, যখন জিনজিয়ানের নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত পণ্য চীনের চেয়েও ভিয়েতনাম বেশি পরিমাণে ব্যবহার করে রপ্তানি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।