চীনের পাল্টা পদক্ষেপ, কিছু সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ

চীনরয়টার্স

সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরও কঠোর করার পদক্ষেপ নিয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা প্রযুক্তি রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধের ডালপালা যখন ধীরে ধীরে আরও বাড়ছে, তখন তার পাল্টা হিসেবে চীনের এই পদক্ষেপ। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই পদক্ষেপে দুই দেশের প্রতিরক্ষাশিল্পের যে যোগাযোগ ছিল, তাতে আরও দ্রুত ছেদ পড়বে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, চীন গত বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছে যে তারা মহাকাশযানের যন্ত্রাংশ, ইঞ্জিন ও বুলেটপ্রুফ ভেস্ট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, এমন কিছু পণ্য রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দেবে। আগামী ১ জুলাই থেকে এই বিধিনিষেধ কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।

কাস্টমসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে এই পণ্য রপ্তানি করে চীন ৮০০ কোটি ডলার আয় করেছিল।

চীনের এই পদক্ষেপের মানে হলো, অনুমতি ছাড়া এসব পণ্য রপ্তানি করা যাবে না। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব কাস্টমস ও কেন্দ্রীয় সেনা কমিশনের সরঞ্জাম উন্নয়ন বিভাগের দেওয়া এক যৌথ ঘোষণায় এ কথা জানানো হয়েছে।

এই বিধিনিষেধের ফলে বেশ কিছু দেশে চীনের এসব পণ্যের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পণ্যগুলো সবচেয়ে বেশি যায় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রাজিলে। আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আনবাউন্ডের গবেষক ঝু চাও বলেন, চীনের বাণিজ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই পদক্ষেপ মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের লক্ষ্য করে নেওয়া হয়েছে।

ঝু চাও বলেন, এটা পরিষ্কার যে চীনের পদক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ। এমন কিছু পণ্যের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, যেগুলোর সঙ্গে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লেষ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, প্রতিরক্ষাশিল্পকে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে। এর ফলে চীনের রপ্তানিতে বিধিনিষেধের পদক্ষেপ এই প্রক্রিয়াকে কেবল জোরদারই করবে।

ঝু চাও মনে করেন, চীনের এই পদক্ষেপের প্রভাব সীমিত হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইতিমধ্যেই চীনের সাপ্লাই চেইনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দিয়েছে। যদিও এর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, তারপরও তারা এটা করেছে।

গত বছর থেকে বাইডেন প্রশাসন চীনের বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রায় এক হাজার বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এবং বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তা, জিনজিয়ান ও ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে উল্লেখ করেছে।

বেইজিং ও প্যারিসে আরবিট্রেশন চেম্বারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী তাও জিংঝু মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যবন্ধনের ছেদ হবে একটি ‘দ্বিমুখী রাস্তা’। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চীনের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। চীনও ঠিক একইভাবে পাল্টা জবাব দিচ্ছে।

তাও জিংঝু বলেন, এই বিধিনিষেধের খেলায় যে খুব বেশি পণ্যের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা নয়। তবে এটা প্রমাণ করছে যে স্পর্শকাতর পণ্যের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করতে চীনা সরকারও পিছিয়ে থাকবে না। গত বছরের জুলাইয়ে বেইজিং কয়েক ধরনের ড্রোন এবং ড্রোন–সর্ম্পকিত সরঞ্জাম রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল।

যেসব পণ্যের দ্বিমুখী ব্যবহার হয়, তেমন পণ্য রাশিয়ার কাছে পাঠানো বন্ধ করতে চীনের ওপর জোর চাপ প্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ ধরনের পণ্য রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করছে বলে পশ্চিমাদের অভিযোগ। তবে চীন যেকোনো অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছে, তারা মস্কোর সঙ্গে সাধারণ বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখছে।

বৃহস্পতিবার বেইজিং বলেছে, সর্বশেষ যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা দেখাচ্ছে যে অস্ত্র বিস্তার রোধে তারা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে।

চীনের এক সামরিক বিশ্লেষক ও পিপলস লিবারেশন আর্মির সাবেক প্রশিক্ষক সং ঝংপিং বলেন, স্পর্শকাতর প্রযুক্তি, বিশেষ করে মহাকাশ ও জাহাজ তৈরিসংক্রান্ত প্রযুক্তি রপ্তানিতে চীন সত্যিকার অর্থে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখছে। কারণ, এগুলো সামরিকভাবে স্পর্শকাতর কিংবা এগুলোর দ্বিমুখী ব্যবহার রয়েছে।

সং ঝংপিং আরও বলেন, চীন সব সময়ই শান্তির জন্য কাজ করছে এবং তারা চায় না যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ুক। এটাই আমাদের মৌলিক উদ্দেশ্য। সুতরাং চীনের এই পদক্ষেপ একেবারেই আশ্চর্যজনক নয়।

তবে নানজিং ইউনির্ভাসিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের নির্বাহী ডিন ঝু ফেং মনে করেন, বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে প্রযুক্তি নিয়ে বর্তমানে যে প্রতিযোগিতা চলছে, রপ্তানি বিষয়ে চীনের পদক্ষেপ প্রাথমিকভাবে তাকেই প্রতিফলিত করছে। তিনি বলেন, ‘এটা প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। আমরা দেখছি, যুক্তরাষ্ট্র চীনের উচ্চপ্রযুক্তির পণ্যের ক্ষেত্রে কঠোর হচ্ছে। এর পাল্টা হিসেবে, চীন তার নিজস্ব প্রযুক্তিকে সুরক্ষা দিচ্ছে।’

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। আর এই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করেই যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে চীন তার বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে, বিশেষ করে যেসব পণ্যের সামরিক ব্যবহার আছে কিংবা যেসব পণ্য সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। চীন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বিধিনিষেধও দিতে পারে।

তবে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সতর্ক করছেন এই বলে যে এ ধরনের পদক্ষেপ উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের উত্তেজনা বাড়ছে।