জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে, সতর্ক করছে বড় কোম্পানিগুলো

ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে লোহিত সাগর দিয়ে সব ধরনের পণ্যবাহী জাহাজ সরিয়ে নিচ্ছে মায়ার্সক।ছবি রয়টার্স।

ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে লোহিত সাগর থেকে সব ধরনের পণ্যবাহী জাহাজ সরিয়ে নিচ্ছে মায়ার্সক ও হাপাগ–লয়েডের মতো বিশ্বের বড় জাহাজ কোম্পানিগুলো। এতে অদূর ভবিষ্যতের জন্য পণ্য সরবরাহে ব্যাঘাত ও খরচ বৃদ্ধি ঘটতে পারে বলে গ্রাহকদের সতর্ক করে দিয়েছে এসব কোম্পানি।

রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, জাহাজ কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, লোহিত সাগরের পরিবর্তে এখন আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ বা কেপ অব গুড হোপ ঘুরে জাহাজ চালাতে হচ্ছে। এতে যাত্রাপথে সময় বেড়েছে এক থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত। আফ্রিকা ঘুরে রাউন্ড ট্রিপ যাতায়াতের কারণে জ্বালানি ও বিমা খরচের পাশাপাশি ক্রু-টাইমও বেশি লাগছে। এতে সব মিলিয়ে বাড়ছে শিপিং খরচ।

গত বছরের অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল। সেই থেকে গাজায় অব্যাহতভাবে বোমা হামলা ও স্থল অভিযান চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি বাহিনী। এমন প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি হামাস যোদ্ধাদের সমর্থন দিতে লোহিত সাগরে পণ্য চলাচলকারী জাহাজে হামলা শুরু করে ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা। কনটেইনারবাহী জাহাজ থেকে শুরু করে তেলের ট্যাংকার—যেকোনো দেশের পতাকাবাহী সব ধরনের জাহাজেই তারা হামলা করছে। এর ফলে সুয়েজ খাল হয়ে লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চলাচল অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।

সুয়েজ খালের মাধ্যমে লোহিত সাগর দিয়ে এশিয়া থেকে ইউরোপে যাতায়াত সংক্ষিপ্ততম পথ। এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত এই পথে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য অংশের জন্য তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, গাড়ি, শস্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বহুজাতিক নৌ টহল দল লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহীদের হামলা ঠেকানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। এ জন্য তৈরি করা হয়েছে মাল্টিন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভস বা বহুপক্ষীয় নিরাপত্তা উদ্যোগ। ভারতও লোহিত সাগরের চারপাশে ভারতীয় কনটেইনারবাহী জাহাজগুলোকে সুরক্ষা দিচ্ছে। এতেও হুতিদের হামলা কমানো যায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে এ পথ দিয়ে চলাচলকারী জাহাজগুলো সরিয়ে নিচ্ছে কোম্পানিগুলো।

১ জানুয়ারি লোহিত সাগরে মায়ার্সকের একটি কনটেইনারবাহী জাহাজে হামলা চালায় হুতিরা। হামলাকারীরা জাহাজে ওঠারও চেষ্টা করে। ডেনমার্কভিত্তিক মায়ার্সক বিশ্বের বড় জাহাজ কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি, যা বিশ্বের কনটেইনার পরিবহন–বাণিজ্যের ছয় ভাগের এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। চলতি সপ্তাহের শুরুতে মায়ার্সক জানায়, একটি জাহাজে হুতি বিদ্রোহীদের হামলার পর লোহিত সাগরের দিকে চলাচলকারী সব জাহাজ থামিয়ে দেবে তারা।

লোহিত সাগরের পরিবর্তে জাহাজগুলো এখন আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে যাতায়াত করছে।
গ্রাফিক্স ছবি: রয়টার্স।

সর্বশেষ গত শুক্রবার মায়ার্সক এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘পরিস্থিতি ক্রমাগত অস্থির হচ্ছে এবং খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাদের হাতে থাকা সব তথ্য নিশ্চিত করছে যে ওই অঞ্চলে (লোহিত সাগর) উচ্চ নিরাপত্তাঝুঁকি অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে অদূর ভবিষ্যতে জাহাজগুলোকে আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপের দিকে সরিয়ে নেওয়া হবে।’

আফ্রিকা ও এশিয়া অঞ্চলের চারপাশে থাকা জাহাজগুলোকে এ বিষয়ে জানানো শুরু করেছে মায়ার্সক। ইতিমধ্যে তারা এশিয়ামুখী পাঁচটি কনটেইনারবাহী জাহাজের মধ্যে চারটিকে আফ্রিকার দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে। মায়ার্সক বলেছে, ‘আমরা অদূর ভবিষ্যতে একটি টেকসই সমাধানের আশা রাখি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলের জটিলতা বিবেচনায় নেওয়া এবং বৈশ্বিক সরবরাহে উল্লেখযোগ্য ব্যাঘাত ঘটার জন্য গ্রাহককে প্রস্তুত থাকার জন্য আমরা সতর্ক করি।’

হুতি বিদ্রোহীরা ২০১৪ সালে ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে নেয়। এর পর থেকে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিরুদ্ধে তাদের তীব্র লড়াই চলছে। এর আগেও হুতিরা এ অঞ্চলে জাহাজে হামলা চালিয়েছে। তবে এবার গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর বাণিজ্যিক জাহাজে তাদের হামলা অনেকটা বেড়ে গেছে।

খরচ বৃদ্ধির বার্তা
জার্মানভিত্তিক কনটেইনার বহনকারী আরেক শীর্ষ জাহাজ কোম্পানি হাপাগ–লয়েড গত ১৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে লোহিত সাগর অঞ্চল দিয়ে চলাচলকারী অন্তত ২৫টি জাহাজকে সরিয়ে নিয়েছে। হাপাগ–লয়েডের এক মুখপাত্র গতকাল রয়টার্সকে বলেন, এতে তাঁদের লাখ লাখ ইউরো বেশি খরচ করতে হয়েছে। পাশাপাশি এলাকা বিবেচনায় যাত্রার সময় এক থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত বিলম্বিত হয়েছে।

বৈশ্বিক কনটেইনারবাহী জাহাজের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চলাচল করে সুয়েজ খাল দিয়ে। কিন্তু বর্তমানে আফ্রিকার একেবারে দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে জাহাজগুলোকে চলাচল করতে বলা হয়েছে। এতে এশিয়া ও উত্তর ইউরোপের মধ্যে প্রতি রাউন্ড ট্রিপের জন্য ১০ লাখ ডলারের অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ হতে পারে।

সরবরাহে বিঘ্নের ঘটনা ইউরোপের শিপিং কোম্পানিগুলোর জন্য অবশ্য এক দিক থেকে ভালো। চলতি বছরের শুরু থেকেই এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। তবে শঙ্কা তৈরি হয়েছে অন্য জায়গায়। সার্বিক পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোতে নতুন করে মূল্যস্ফীতির উদ্বেগ বাড়ছে।

বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস গত শুক্রবার বলেছে, লোহিত সাগর থেকে সরে অন্যপথে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে দীর্ঘ সময় লাগায় মূল্যস্ফীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। শিপিং খরচ বৃদ্ধির কারণে সংস্থাটি ইতিমধ্যে ইউরো অঞ্চলে মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস ২ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৩ শতাংশ করেছে।

গোল্ডম্যান স্যাকস বর্তমান পরিস্থিতিকে করোনা মহামারি সময়ের সঙ্গে তুলনা করে বলেছে, আমাদের ইকুইটি বিশ্লেষকেরা আশা করছেন, বর্তমানে জাহাজের সরবরাহ ভালো থাকার কারণে করোনার সময়ের (২০২০-২২) মতো ধাক্কা ততটা খারাপ বা দীর্ঘায়িত হবে না, কিংবা বন্দরে কোনো জাহাজজটও হবে না।