আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
দ্বিগুণ করতে হবে প্রত্যক্ষ কর
২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছে। এ কারণে নানামুখী চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে।
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে ২০২৬ সালের নভেম্বরে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে মর্যাদা এক ধাপ বাড়লেও এ ঘটনা কিন্তু দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমবে। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এত দিন বহির্বিশ্ব থেকে যেসব শুল্ক সুবিধা পেয়ে আসছিল, ২০২৬ সালের পর সেগুলো থাকবে না।
উন্নয়নশীল দেশ হয়ে যাওয়ামাত্রই বাংলাদেশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধান বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। এতে নানামুখী চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে।
এমন একটা সময়ে এলডিসি থেকে উত্তরণ হচ্ছে, যখন বাংলাদেশ শুধু উন্নয়নশীল দেশ নয়, মধ্যম আয়ের দেশেও পরিণত হচ্ছে। এতে একদিকে রাজস্ব আয় ও রপ্তানি আয় কমবে, অন্যদিকে বাড়বে বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয়।
এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন ও তদারকির বিষয়ে ২০২১ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউসের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে জমা দেওয়া তিনটি প্রতিবেদনে চ্যালেঞ্জের কথাগুলো উঠে এসেছে।
করবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দেশে কর সংগ্রহের পরিমাণ কম। প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করের অনুপাত ৩৫: ৬৫। অতিদ্রুত তা ৭০: ৩০ করতে হবে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশকে এখন প্রত্যক্ষ কর আহরণে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, রপ্তানি বৃদ্ধিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করতে হবে।
এদিকে ডব্লিউটিও প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পরে বাড়তি শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি ৫৩৭ কোটি ডলার বা ৫১ হাজার কোটি টাকা আয় কমতে পারে।
নগদ সহায়তা আর নয়
জাতীয় কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বর্তমানে ৪৩টি পণ্যে রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দিচ্ছে। ২০২৬ সালের পর তা আর দেওয়া যাবে না। তখন কৃষিপণ্য রপ্তানিতেও ভর্তুকি দিতে পারবে না।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ আসছে এটা ঠিক। আমরাও মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রতিযোগিতা সক্ষমতার জন্য সরকারি সহযোগিতা দরকার।’
চাই এনবিআরের সংস্কার
করবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আয়কর ও মূসকের আওতা বাড়াতে হবে। করযোগ্য বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আয়কর ও মূসকের আওতায় আনতে হবে। করহার কমিয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির কৌশল বের করতে হবে। সব মিলিয়ে দরকার এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার।
বর্তমানে আমদানি শুল্ক বাবদ ৩৪ শতাংশ রাজস্ব সংগ্রহ করা হয়। এই হার চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরে ২৪ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২২ শতাংশ, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ২০ শতাংশ এবং ২০২৫–২৬ অর্থবছরে ১৮ শতাংশে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।
শুল্কহার যৌক্তিক করার সুপারিশ
অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব কাস্টমস সংস্থা ও ডব্লিউটিওর বিধিবিধান মেনে বাংলাদেশকে সব ধরনের শুল্কহার যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য রাজস্ব আয় অনেক কমবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে বর্তমানে ন্যূনতম আমদানিমূল্য বেঁধে দেওয়ার একটি চর্চা রয়েছে, যা ডব্লিউটিওর বিধিবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। সে জন্য চলতি অর্থবছরে ৩৫টি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২২টি এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১২৭টি পণ্যের ওপর থেকে ন্যূনতম আমদানিমূল্য তুলে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন একটা সময়ে এলডিসি থেকে উত্তরণ হচ্ছে, যখন বাংলাদেশ শুধু উন্নয়নশীল দেশ নয়, মধ্যম আয়ের দেশেও পরিণত হচ্ছে। এতে একদিকে রাজস্ব আয় ও রপ্তানি আয় কমবে, অন্যদিকে বাড়বে বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয়।’
দর–কষাকষি করে বাংলাদেশকে এখন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সুবিধা বৃদ্ধির দিকে এগোতে হবে বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, তিনটি চরিত্র নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে বাংলাদেশকে। এগুলো হচ্ছে এলডিসি, উত্তরকালীন এলডিসি ও উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল হলেও এলডিসির সুবিধাগুলো যাতে ৬ থেকে ৯ বছর অব্যাহত থাকে, সেই চেষ্টাই চালিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে।