দান করে এগিয়ে আছেন এশিয়ার যে ধনীরা, শীর্ষ দশে আছেন যাঁরা

এখন সময় এশিয়ার। এই অঞ্চলে দ্রুত হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে এই অঞ্চলে নতুন ধনীর সংখ্যা বাড়ছে, এই শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে। সেই ধনীরা এখন দাতব্যকাজে অর্থসম্পদ দিতে এগিয়ে আসছেন। ফলে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো এখন তাদের এমন দাতব্য কাজের খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপছে।

বাস্তবতা হলো, চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় শিল্প, প্রযুক্তি, আবাসন ও আর্থিক খাতের বিস্তারের ফলে বিপুল সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে। এই সম্পদ সৃষ্টির পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা ও দানধ্যানের বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে।

এই বাস্তবতায় ফোর্বস ম্যাগাজিন এশিয়ার ১০ জন দাতাকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছে; যদিও এই তালিকা ক্রমিক নয়। অর্থাৎ কে বেশি দান করেছেন, তার ভিত্তিতে এই তালিকা করা হয়নি। গত দুই বছরের দানের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই তালিকা করা হয়েছে।

ইউ রেনরং, দেশ: চীন, প্রতিষ্ঠান: অমনিভিশন ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট গ্রুপ

চীনের শতকোটিপতি ইউ রেনরং ২০২৪ সালে শিক্ষা খাতে বড় দান করেছেন। নিজের প্রতিষ্ঠিত চিপ কোম্পানি ওমনিভিশন ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটস গ্রুপের শেয়ার থেকে প্রায় ৬৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের শেয়ার দান করেছেন তিনি।

ইস্টার্ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি নামের প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইউ রেনরং এই দান করেছেন। এটাই শেষ নয়, তিনি ধাপে ধাপে মোট ৪২০ কোটি ডলারের মতো দান করার পরিকল্পনা করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নতুন উদ্ভাবন, সেমি–কন্ডাক্টরসহ বিভিন্ন আধুনিক বিষয়ে পড়ানো হচ্ছে। ২০২৪ সালে প্রথম দফায় প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয় নতুন এই প্রতিষ্ঠানে। লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজার ও কর্মীর সংখ্যা ১ হাজার ৪৫০-এ উন্নীত করা।

জেফরি চিয়া, দেশ: মালয়েশিয়া, প্রতিষ্ঠান: সানওয়ে গ্রুপ

মালয়েশীয় শতকোটিপতি জেফরি চিয়া ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে নিজের প্রতিষ্ঠিত সানওয়ে ইউনিভার্সিটির জন্য প্রায় ১২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের তহবিল গঠনের অঙ্গীকার করেন। সেলাঙ্গর রাজ্যের দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে তিনি আরও ১৭ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছেন। তাঁর ব্যবসা মূলত আবাসন ও স্বাস্থ্য খাতে।

শিক্ষানুরাগী মানুষ হিসেবে এই ব্যক্তি নিজের নামে জেফরি চিয়া ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই ফাউন্ডেশন এখন পর্যন্ত বৃত্তি ও বিভিন্ন অনুদান হিসেবে মোট প্রায় ২৪ লাখ মার্কিন ডলার বিতরণ করেছে।

দোশি ব্রাদার্স, দেশ: ভারত, প্রতিষ্ঠান: ওয়ারি এনার্জিস

ভারতের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান ওয়ারি এনার্জিসের উদ্যোক্তারা দানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ২০২৪ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত কোম্পানিটির বার্ষিক শেয়ারহোল্ডার সভায় কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিতেশ দোশি ঘোষণা দেন, তিনি ও তাঁর তিন ভাই—পঙ্কজ, কিরিত ও বীরেন দোশি মিলে কোম্পানির ১ শতাংশ শেয়ার দান করবেন। বর্তমান শেয়ারদরের হিসাবে এই শেয়ারের বাজারমূল্য ১০ কোটি ডলারের বেশি। এই শেয়ার আগামী ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে ধাপে ধাপে ওয়ারি ফাউন্ডেশনে হস্তান্তর করা হবে। ভারতের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক উন্নয়নে দান করতে চান তাঁরা। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় ও ছাত্রদের থাকার জন্য হোস্টেল নির্মাণ করতে চান এই তিন ভাই।

উই উয়েই লিং ও উই ই চেয়ং, দেশ: সিঙ্গাপুর, প্রতিষ্ঠান: উই ফাউন্ডেশন

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে উই ফাউন্ডেশন এবং এই পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংক সিঙ্গাপুরের ন্যানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির জন্য ৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার অনুদান দেয়। সরকারের অনুদানসহ এই তহবিলের আকার বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা হিসেবে এই অর্থ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও এই অর্থ ব্যয় করা হবে।

গত জুলাই মাসে এই ফাউন্ডেশন নার্সিং একাডেমিক ফান্ডে আরও ৪৫ লাখ ডলার অনুদান দেয়। এই পরিবারের দুই সদস্য উই উয়েই লিং ও উই ই চেয়ং এই ফাউন্ডেশন পরিচালনা করেন। তাঁরা ভাই–বোন।

রবিন খুদা, দেশ: অস্ট্রেলিয়া, প্রতিষ্ঠান: এয়ারট্রাঙ্ক

রবিন খুদার পরিবার দাতব্যকাজের জন্য প্রসিদ্ধ। খুদা ফ্যামিলি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তারা দান করে থাকে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে খুদা ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ কোটি অস্ট্রেলীয় ডলার অনুদান দেয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ২০ বছরব্যাপী এই কর্মসূচির জন্য এই অর্থ দেওয়া হয়েছে। কেবল শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া এর লক্ষ্য নয়, বরং স্কুলপর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মেয়েদের জন্য সুযোগ তৈরি করা এর লক্ষ্য।

২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য হচ্ছে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা বৃদ্ধি করা। সেই সঙ্গে প্রতিভাবানেরা যেন সুযোগের অভাবে ঝরে না পড়েন, সেটা নিশ্চিত করা।

রবার্ট এনজি ও ড্যারিল এনজি, দেশ: হংকং, প্রতিষ্ঠান: এনজি টেং ফং চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন

২০২৪ সালের মার্চ মাসে শতকোটিপতি রবার্ট নং ও তাঁর ছেলে ড্যারিল নং পারিবারিক প্রতিষ্ঠান এনজি টেং ফং চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন ও সিনো গ্রুপের মাধ্যমে হংকংয়ের এআই উন্নয়নে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার অনুদান দেন। হংকংয়ের জেনারেটিভ এআই রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারকে (এইচকেজিএআই) সহায়তা করা ছিল এর লক্ষ্য। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ফাউন্ডেশন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ও সংস্কৃতিতে অবদান রাখছে।

আর্চি হুয়াং, দেশ: তাইওয়ান, প্রতিষ্ঠান: হার্মেস এপিটেক

ন্যাশনাল ইয়াং মিং চিয়াও তুং ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন আর্চি হুয়াং। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে আর্চি হুয়াং নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার মূল্যের চিকিৎসা সরঞ্জাম দান করেন তিনি। ক্যানসার চিকিৎসাসংক্রান্ত গবেষণায় এই অর্থ খরচ করা হবে। বোরন নিউট্রন ক্যাপচার থেরাপির উন্নয়নে এই অর্থ ব্যয় হবে। রেডিওথেরাপির মাধ্যমে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করা হলেও ভালো কোষ রক্ষা করা হয়। এই চিকিৎসাপদ্ধতি তাইপে ভেটেরান্স জেনারেল হসপিটালে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সোলিনা চাউ, দেশ: হংকং, প্রতিষ্ঠান: হোরাইজন ভেঞ্চার্স

ধনীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই দান করেন। সোলিনাও একই কাজ করেছেন। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে শতেকাটিপতি ও প্রযুক্তিবিষয়ক বিনিয়োগকারী সোলিনা চাউ ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসকে ১ কোটি ৯৫ লাখ ডলার অনুদান দেন। হোরাইজন্স বিল্ডিং নামে আবাসিক কলেজ নির্মাণে এই অর্থ খরচ হবে। মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে যে মেয়েরা পড়াশোনা করছেন, এই হোস্টেল সেই মেয়েদের জন্য তৈরি হবে। চাউ ১৯৯৬ সালে এইচএসপাউ ফাউন্ডেশন স্থাপন করেন। এ পর্যন্ত নারীদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় ২০ কোটি ডলারের বেশি অনুদান দিয়েছেন তিনি।

লো টাক কওং, দেশ: ইন্দোনেশিয়া, প্রতিষ্ঠান: বায়ান রিসোর্সেস

কয়লার ব্যবসা করে শতকোটিপতি হয়েছে লো টাক। মার্চ মাসে নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত লো টাক কওং ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের ন্যানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটিকে ৬১ লাখ ডলার অনুদান দেন তিনি। এই অর্থ সিঙ্গাপুরের স্নাতকদের জন্য আর্থিক সহায়তা এবং ইন্দোনেশীয় স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়ার উদ্দেশে ব্যবহৃত হবে।

লো টাক কওং এর আগে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ও ইউনিভার্সিটি অব ইন্দোনেশিয়ায় অনুদান দিয়েছেন। ২০২৩ সালে তিনি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ পাবলিক পলিসি স্কুলকে রেকর্ড ৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার অনুদান দেন।

১০

সাইরাস পুনাওয়ালা ও আদর পুনাওয়ালা, দেশ: ভারত, প্রতিষ্ঠান: সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া

সাইরাস পুনাওয়ালা ও তাঁর ছেলে আদর ভ্যাকসিন বিলিয়নিয়ার বা টিকা খাতের শতকোটিপতি হিসেবে খ্যাত। ২০২৪ সালে তাঁরা সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের সায়েন্স মিউজিয়ামকে ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার অনুদান দেন। এটি জাদুঘরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক অনুদান। এর মাধ্যমে জাদুঘরের মেকিং অব দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড শীর্ষক গ্যালারি এজেস অব ইনভেনশন: দ্য সেরাম ইনস্টিটিউট গ্যালারিতে রূপান্তরিত হবে। ২০২৮ সালে এটি চালুর পরিকল্পনা আছে। ২ হাজার ২০০ বর্গমিটারের এই গ্যালারিতে গত ২৫০ বছরের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন প্রদর্শিত হবে।