কেন দেশ ছাড়তে চায় ইসরায়েলের স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো

প্রায় প্রতি সপ্তাহেই হাজারো ইসরায়েলি নাগরিক তেল আবিবের রাস্তায় নেমে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। দেশটিতে ৩০ সপ্তাহ ধরে এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ইসরায়েলের সরকারের কিছু পদক্ষেপে বিচার বিভাগ দুর্বল এবং সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতা খর্ব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সে কারণেই সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন দেশটির সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা।

সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, সম্প্রতি তেল আবিবের কাপলান স্ট্রিটে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন চেন অ্যামিট। তিনি টিপাল্টি নামের একটি প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক সেবা স্টার্টআপের সহপ্রতিষ্ঠাতা—সম্প্রতি যার বাজারমূল্য নির্ধারিত হয়েছে প্রায় ৮৩০ কোটি ডলার। তিনি এবং তাঁর পরিবার প্রতি সপ্তাহে রাস্তার প্রতিবাদে যোগ দিচ্ছেন। অ্যামিট সিএনএনকে বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রের জন্য চিৎকার করি এবং তার জন্য লড়াই করি।’
২০১০ সালে অ্যামিট ও অরেন জিভ নামক এক ব্যক্তি ইসরায়েলে তাদের ফার্মটি প্রতিষ্ঠা করেন। কোম্পানিটি ইসরায়েলে অবস্থিত হলেও এর কার্যালয় ক্যালিফোর্নিয়ার ফস্টার সিটিতে অবস্থিত।

গত মাসে তেল আবিবের একটি শপিং সেন্টারের কাছে এক ফিলিস্তিনি ফুটপাতে গাড়ি উঠিয়ে দেয় ও গাড়ি থেকে নেমে আটজনকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। অ্যামিটের কার্যালয় থেকে এই জায়গাটা দেখা যায়।
অ্যামিটের মতে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নয়, বরং তাঁর নিজের সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। দেশটির বর্তমান বিচারিক কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনা, অনিশ্চয়তা, বাধা ও ঝুঁকি তাঁকে টিপাল্টির অর্থ ও কর্মীদের বিদেশে স্থানান্তর করতে বাধ্য করছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

নিয়ম অনুযায়ী এই কোম্পানি কর্মীদের তিন মাসের বেতন ছাড়া বাকি সব অর্থ ইসরায়েলের বাইরে রাখছে। বিচার বিভাগের সংস্কারে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে যেন কোম্পানি ক্ষতির মুখে না পড়ে, সে লক্ষ্যে কোম্পানিটি এল-ওয়ান ভিসার মাধ্যমে স্থানীয় কর্মীদের আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছেন অ্যামিট। তিনি আরও বলেন, আগামী ১৮ মাসে ১৫ শতাংশ ইসরায়েলি কর্মী যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাবেন বলে তিনি ধারণা করছেন।
অ্যামিট একা নন; অলাভজনক প্রতিষ্ঠান স্টার্ট-আপ নেশন সেন্ট্রাল বা এসএনসির ৫০০টি কোম্পানিকে নিয়ে করা এক জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ স্টার্টআপ কোম্পানি তাদের কর্মী, অর্থ ও সদর দপ্তর ইসরায়েলের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে কিছু কিছু কোম্পানি কর্মী ছাঁটাইও করছে।
এই প্রবণতার কারণে ইসরায়েলের সাত হাজার স্টার্টআপে প্রতিবছর যে অর্থায়ন হয়, তা কমছে বলে মন্তব্য করেছেন এসএনসির পরিকল্পনা বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট আরি স্ট্রাসবার্গ। তিনি বলেন, ইসরায়েলে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। গত বছরের তুলনায় এই বছরের বিনিয়োগ ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগ কমে যাওয়ার প্রবণতা ইসরায়েলের জন্য বেশ চিন্তার কারণ। শুধু শেষ ত্রৈমাসিকে ইসরায়েলে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ কমেছে।
এসএনসির তথ্যমতে, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ইসরায়েলি স্টার্টআপগুলো ৩৯০ কোটি ডলার বেসরকারি বিনিয়োগ পেয়েছে; ২০১৮ সালের পর যা সর্বনিম্ন।
এসব কিছুর প্রভাবে ইসরায়েলি মুদ্রার মানে কিছুটা পতন হয়েছে। মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক মরগান স্ট্যানলি, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডিস ও ইসরায়েলের নিজস্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সতর্কতার মধ্যে এই বছর মার্কিন ডলারের বিপরীতে ইসরায়েলি মুদ্রা সেকেলের দর ৫ শতাংশ কমেছে। এরা বরাবরই বলে আসছে, বিচার বিভাগের সংস্কারের কারণে ইসরায়েলের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, ঋণমানের সম্ভাব্য অবনমন, বিনিয়োগ হ্রাস ও সেকেলের দুর্বল অবস্থানের কারণে বছরে ইসরায়েলের জিডিপিতে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার ক্ষতি হতে পারে।

ইসরায়েল সরকারের মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে সিএনএনের কাছে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। গত মাসে এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মটরিখ অর্থনীতি নিয়ে আশঙ্কা নাকচ করেছেন। তাঁরা বলেন, এই সমস্যা সাময়িক। সবকিছু যখন শান্ত হবে, তখন দেখা যাবে যে ইসরায়েলের অর্থনীতি খুবই শক্তিশালী। ইসরায়েলের অর্থনীতি দৃঢ় ভিত্তি ও অভিজ্ঞ নেতৃত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে—এই হচ্ছে দেশটির নেতাদের অবস্থান।
কিন্তু দেশটির প্রযুক্তি খাত সংকুচিত হলে সেই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে বলে সিএনএনের সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইসরায়েলের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় অর্ধেক আসে প্রযুক্তিনির্ভর বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশীয় স্টার্টআপগুলোর বদৌলতে। এসএনসির মতে, প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপগুলো ২০২২ সালে ১ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ সংগ্রহ করেছে। অঙ্কের হিসাবে যদিও তা খুব একটা বড় নয়, দেশটির জিডিপির ৩ শতাংশের কম।
ইসরায়েলের প্রতিবাদী মানুষেরা এখনো আশা করছেন, সরকার আগের অবস্থান থেকে সরে আসবে বা বিচার বিভাগের সংস্কার বিল সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করবে। এ সবকিছু না হলে ব্যাপক বিক্ষোভ অব্যাহত থাকবে, যদিও তা মূলত শান্তিপূর্ণ। অ্যামিট ও তাঁর পরিবার সেই আন্দোলনে শামিল থাকবে, তবে স্টার্টআপ জাতি হিসেবে খ্যাত ইসরায়েলকে এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে নতুন পথ খুঁজতে হবে।