বিশ্বব্যাংক: ‘যতটা মার্কিন ব্যাংক, এখন ঠিক ততটাই ভারতীয় ব্যাংক’

বিশ্বব্যাংক
ফাইল ছবি

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অজয় বাঙ্গার সামনে কার্যত আর কোনো বাধা নেই। আর কোনো মনোনয়ন জমা না পড়ায় তাঁর এই বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ধারণা করা হচ্ছে, অজয় বাঙ্গা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উঠবে। তবে বিশ্বব্যাংকের কাঠামোতে কতটা পরিবর্তন আসবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে শঙ্কা আছে। খবর ইকোনমিক টাইমসের।

এশিয়ার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন জিম ইয়ং কিম। তিনি ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিমের জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে। সেখান থেকে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।

কিন্তু অজয় বাঙ্গা তেমন নন– তাঁর পড়াশোনা ভারতে, ক্যারিয়ারও শুরু করেছিলেন তিনি দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশে। ২০০০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং সে দেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন ২০০৭ সালে।

সম্ভবত জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে বসবেন অজয় বাঙ্গা। তখন আরেকটি নতুন রেকর্ড হবে। সেটা হলো, বিশ্বব্যাংকের তিন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকবেন তিন ভারতীয়—প্রেসিডেন্ট পদে বাঙ্গা, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তার পদে অংশুলা কান্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদের পদে ইন্দরমিত গিল।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক নয়াদিল্লি কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা ইকোনমিক টাইমসকে বলেন, এখন বিশ্বব্যাংক যতটা মার্কিন ব্যাংক, ঠিক ততটাই ভারতীয় ব্যাংক। তিনি আরও বলেন, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ভারতীয়দের এমন উপস্থিতি সচরাচর দেখা যায় না। এমনকি এ মুহূর্তেও বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে মার্কিনীদের চেয়ে ভারতীয়দের সংখ্যাই বেশি।

বিশ্বব্যাংকের বর্তমান প্রধান ঝুঁকি কর্মকর্তা লক্ষ্মী শ্যামসুন্দরও একজন ভারতীয়।

বিশ্বব্যাংকের এই শীর্ষ ভারতীয় কর্মকর্তারা সরাসরি ভারতীয় কর্মসূচিতে কাজ না করলেও বাস্তবতা হলো, ভারত বিশ্বব্যাংকের সবচেয়ে বড় গ্রাহক। সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারও বটে।

২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি পরিমান ঋণ পাওয়ার দিক থেকে বিশ্বে তাদের স্থানই প্রথম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ার চেয়ে তারা অনেক এগিয়ে।

ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি) ও ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ)—এই দুটি তহবিল যৌথভাবে বিশ্বব্যাংক হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে আইবিআরডি মধ্যম আয় ও কিছু নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে ঋণ দেয়। আইডিএ গরিব দেশগুলোকে বিনা সুদে ঋণ দেয়। ভারত সর্বশেষ ২০১৩ সালে আইডিএ থেকে ঋণ নিয়েছিল। এখন তারা উল্টো আইডিএ তহবিলে চাঁদা দেয়।

বিশ্বব্যাংকের তিনটি সংস্থার মধ্যে একটি হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। এটি বেসরকারি খাতে ঋণ দিয়ে থাকে। এই আইএফসি থেকে এখন সবচেয়ে বেশি ঋণ পায় ভারত। সংস্থাটির ১০ শতাংশ ঋণ পায় দেশটি।

আর ওয়াশিংটনের বাইরে বিশ্বব্যাংকের সবচেয়ে বড় কার্যালয় ভারতে। এ পর্যন্ত ভারত ৬৭৩টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১২৮ বিলিয়ন বা ১২ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পেয়েছে।

ভারত কি আরও ঋণ পাবে
ভারত ২০৪৭ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হতে চায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার আরও ঋণ দরকার। বিশ্বব্যাংকের ভারত অঞ্চলের প্রধান অগাস্তে তানো কৌমে ইকোনমিক টাইমসকে বলেন, বর্তমানে আইবিআরডির ঋণের ১৪ শতাংশই ভারত পাচ্ছে।

তিনি বলেন, দরকার হলে ভারতকে আরও সহযোগিতা করা হবে। তবে কতটা অর্থ সহায়তা দেওয়া যাবে, তা নির্ভর করবে বিশ্বব্যাংকের স্থিতিপত্রের ওপর।

কাঠামোগত পরিবর্তন
বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের রীতিতে চলছে। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকের প্রধান হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনোনীত একজন ব্যক্তি, আর আইএমএফের প্রধান হবেন ইউরোপীয়দের পছন্দে। আবার যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, আইএমএফে যার কার্যকর ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মত রাশিয়াও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য।

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ—এই দুই প্রতিষ্ঠানেই সদস্যদের ভোট প্রদানের ক্ষমতা অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। তা-ও সেটা আজকের যুগের অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তিতে নয়, বরং এদের প্রতিষ্ঠাকালীন আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে।

আইবিআরডিতে ভারতের ভোট প্রদানের ক্ষমতা মাত্র ৩ শতাংশ। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সেই ক্ষমতা ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ, জাপানের ৭ দশমিক ৩ শতাংশ আর চীনের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎস তাঁর ‘মেকিং গ্লোবালাইজেশন ওয়ার্ক’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিনিধিত্বের ধরন ও নীতিতেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে তাঁর মত। দ্বন্দ্ব নিরসনের পদ্ধতিও উন্নত করার পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আরও উন্মুক্ত করার পক্ষপাতী তিনি।

বিশ্লেষকেরা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব চলতে পারে না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্বব্যবস্থায় ভারসাম্য আনার জন্যই এটা দরকার। কিন্তু নেতৃত্বস্থানীয় দেশগুলোর মনোভাবে পরিবর্তন না এলে সংস্থাটির কাঠামোগত পরিবর্তন হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

এ ক্ষেত্রে অজয় বাঙ্গা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।