প্রবৃদ্ধির বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি যথাযথ নয়: ডব্লিউইএফ

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) লোগোছবি: সংগৃহীত

২০০৭ সালের আর্থিক সংকটের পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেছে। সারা বিশ্বেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। চলতি শতকের প্রথম ভাগে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২ শতাংশ এবং উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে তা ছিল ৬ শতাংশ, কিন্তু কোভিড–উত্তর সময়ে তা যথাক্রমে ১ দশমিক ৫ ও ২ শতাংশে নেমে এসেছে।

এই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগাতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) সম্প্রতি ‘ফিউচার অব গ্রোথ বা প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে নতুন এক প্রবৃদ্ধির কাঠামোর প্রস্তাব করেছে। মূলত চারটি ভিতের ওপর তাদের এই প্রস্তাবিত কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো হলো উদ্ভাবন, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন ও ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা।

প্রবৃদ্ধির জন্য নতুন একটি কাঠামোর প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। তাতে চারটি ভিতের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো উদ্ভাবন, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন ও ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা।
আরও পড়ুন

২০২০ সালে কোভিড সংক্রমণের পর থেকে একের পর এক ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। এসব কারণে অর্থনীতি গতি হারিয়ে ফেলেছে। কোভিডের প্রভাব কাটতে না কাটতেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা শুরু হয়, প্রতিনিয়ত যার পরিসর বাড়ছে। সেই সঙ্গে আর্থিক ও পরিবেশগত নানা সংকটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি একরকম স্থবির হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এই বাস্তবতায় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম মনে করছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এখন যে দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে, তা যথাযথ নয়।

ডব্লিউইএফ বলছে, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগানো জরুরি। তবে এ জন্য তারা স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের পক্ষপাতী নয়। সংস্থাটি বলছে, যেকোনো মূল্যে স্বল্প মেয়াদে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে গেলে পরিবেশের ক্ষতি হয় ও অসমতা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া স্বল্প মেয়াদে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে গেলে সংকট মোকাবিলা করে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতাও বিনষ্ট হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো দরকার কি না, সেটি প্রশ্ন নয়; বরং প্রশ্ন হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির অন্তর্নিহিত প্রকৃতি অর্থনীতির অন্যান্য অগ্রাধিকার আমলে নিতে পারে কি না, সেটি। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতি ডব্লিউইএফের প্রস্তাবিত উদ্ভাবনী, অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই ও ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতাসম্পন্ন প্রবৃদ্ধি থেকে এখনো অনেক দূরে।

বিশ্ব অর্থনীতি এই পথ কেবল অর্ধেক পাড়ি দিয়েছে। ডব্লিউইএফ চারটি ভিতের ওপর শূন্য থেকে ১০০ পর্যন্ত নম্বরের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির মূল্যায়ন করেছে। সেখানে দেখা গেছে, উদ্ভাবনের নিরিখে বিশ্ব অর্থনীতি পেয়েছে ৪৫ দশমিক ২; অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পেয়েছে ৫৫ দশমিক ৯; টেকসই উন্নয়নে ৪৬ দশমিক ৮ আর ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতার ক্ষেত্রে ৫২ দশমিক ৮।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব দেশের জন্য প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ একরকম নয়। তবে কিছু শিক্ষা প্রায় সব দেশের ক্ষেত্রে একই রকম। অধিকাংশ দেশ জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত নয়। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে মেধাসংকট উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সেবা বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু সেই দেশগুলো ডিজিটাইজেশনে পিছিয়ে থাকার কারণে এই সুযোগ সেভাবে নিতে পারছে না।

উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ডিজিটাইজেশনের হার একরকম নয়; বরং তাদের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে, ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে এবং উদ্ভাবনের সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে। মোদ্দাকথা হলো, ডিজিটাইজেশন ও তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সেবা কাঠামো যেকোনো অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে গত কয়েক দশকের মধ্যে আয় অসমতা বাড়তে শুরু করেছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করে ডব্লিউইএফ। এ ছাড়া কার্বন নিঃসরণের বিষয়টি এখনো প্রবৃদ্ধির মডেলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি বলেও মনে করে সংস্থাটি। ফোরাম মনে করছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেভাবে অন্তর্মুখী নীতি প্রণয়ন করছে, সেটি তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়।

প্রবৃদ্ধির চিত্র

২০১৮–২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের উচ্চ আয়ের দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ০১ শতাংশ। তবে ফোরামের প্রণীত চারটি মানদণ্ডে এই দেশগুলো এগিয়ে আছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে ১০০–এর মধ্যে দেশগুলো পেয়েছে ৬৮ দশমিক ৯, উদ্ভাবনে ৫৯ দশমিক ৪, টেকসই উন্নয়নে ৪৫ দশমিক ৮।

একই সময়ে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এই দেশগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে পেয়েছে ৫৪ দশমিক ৮, ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতায় ৫০, টেকসই উন্নয়নে ৪৪ আর উদ্ভাবনে ৩৯ দশমিক ৩। আর বিশ্বের নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এই দেশগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতায় পেয়েছে ৪৫ দশমিক ৮, টেকসই উন্নয়নে ৫০, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে ৪৪ দশমিক ৮ আর উদ্ভাবনে ৩৪ দশমিক ৯।

উল্লিখিত সময়ে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধি ছিল শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ। টেকসই উন্নয়নে এরা পেয়েছে ৫২ দশমিক ৭, ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতায় ৩৯, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে ২৯ দশমিক ৯ আর উদ্ভাবনে ২৬ দশমিক ৮।