চীনারা কেন শত শত ফরাসি ওয়াইন তৈরির প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিচ্ছেন
ফ্রান্সের বোর্দো অঞ্চলের ওয়াইন পৃথিবী বিখ্যাত। এক দশকের বেশি সময় ধরে এখানে একের পর এক ওয়াইন খামার কিনেছেন চীনের বিনিয়োগকারীরা। তাঁদের স্বপ্ন ছিল, ফ্রান্সে জৌলুশপূর্ণ জীবন কাটাবেন আর নিজেদের দেশে ওয়াইন পাঠিয়ে কাঁচাপয়সা আয় করবেন; কিন্তু সেই চীনা বিনিয়োগকারীরা এখন সেসব ভূসম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছেন।
চীনে পুঁজির ওপর নিয়ন্ত্রণ, এশিয়ায় ওয়াইনের চাহিদা পড়ে যাওয়া এবং ফ্রান্সে একটি ওয়াইন তৈরির প্রতিষ্ঠান চালাতে যে অর্থ খরচ হতে পারে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকা—এসব কারণে চীনের এসব অতি উৎসাহী বিনিয়োগকারীদের মাটিতে নামিয়ে এনেছে বলে এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এসব বিনিয়োগকারী এখন সবকিছু বেচতে পারলেই বাঁচেন।
চীনের বিনিয়োগকারীরা প্রথম যেসব আঙুরের বাগান কিনেছিলেন, তাঁদের একটি ছিল শ্যাতো লাতু লাগুয়েন। ২০০৯ সালের ঘটনা সেটি। একটি চীনা কোম্পানি এই ওয়াইন তৈরির প্রতিষ্ঠান কিনেছিল—মোটামুটি এই ধারণা থেকে যে চীনের বাজারে এই পানীয় বিক্রি করে তারা বেশি ভালো আয় করতে পারবে।
এরপর দক্ষিণ–পশ্চিম ফ্রান্সে অবস্থিত দুই শর বেশি ভূসম্পত্তি চীনাদের কাছে বিক্রি হয়ে যায়।
লংহাই ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের উত্তরাধিকারী ডেইজি হাইয়ান চেং এখন শ্যাতো লাতুরের মালিক। নব্য–মধ্যযুগের এই ভবনের জন্য তাঁর চমৎকার পরিকল্পনা ছিল। একটি ওয়াইন টেস্ট করার রুম, হাল ফ্যাশনের প্রসাধনসামগ্রীর দোকান এবং অতিথিদের জন্য বিলাসবহুল কামরা।
তবে আজ ওই স্যাঁতসেতে ভবনে কেবল বাদুড় বাস করে। শ্যাতোর মালিক এখন এটি নিলামে তুলেছেন। নিলামের ডাক শুরু হবে দেড় লাখ ইউরো বা ১ লাখ ৬২ হাজার ডলার দাম দিয়ে। এর মধ্যে অবশ্য আঙুর বাগানের দাম ধরা নেই। আরও বেশ কিছু ভূসম্পত্তি চীনা মালিকেরা সম্প্রতি তাঁদের স্বপ্নে ইতি টেনেছেন।
গত মে মাসে ফরাসি কর্তৃপক্ষ নয়টি শ্যাতো জব্দ করেছে। ২০১০–এর দশকে এসব শ্যাতো চীনা ধনকুবের নাইজি ছু কিনেছিলেন। হাইচাং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর এই প্রতিষ্ঠাতা কিছুদিন আগে দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত হয়েছেন।
বোর্দোর মানচিত্র থেকে ২০২২ সালে গোল্ডেন র্যাবিট, ইম্পেরিয়াল র্যাবিট, গ্রেট অ্যান্টিলোপ এবং টিবেটান অ্যান্টিলোপের বিলোপ ঘটে। তবে এগুলো ধ্বংস হয়ে যায়নি। এ চারটি শ্যাতো কিনে নিয়ে বোর্দোর মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নতুন নাম দিয়েছিলেন চীনা মালিক চি কেয়াং টং। ফরাসি বিনিয়োগকারীদের কাছে পুনরায় বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর এগুলো পুরোনো নামে ফিরে যায়।
বোর্দো এলাকায় সম্পত্তি বেচাকেনায় সহায়তাকারী এবং এশীয় বাজার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ লি লিজুয়ান বলেন, আরও বেশ কিছু শ্যাতো একেবারে পানির দামে বিক্রির জন্য প্রস্তুত। তিনি জানান, চীনে পুঁজির ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা হয়েছে এবং একই সময়ে বোর্দোতে প্রচুর পরিমাণে ওয়াইন তৈরি হচ্ছে।
লি লিজুয়ান বলেন, ‘চীনের বিনিয়োগকারীরা আর বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারছেন না; কারণ তাঁদের অর্থ চীনে আটকে পড়ে আছে।’
অলীক আশা
বোর্দো এলাকায় চীনাদের যত শ্যাতো ছিল, তার ৮০ শতাংশের মালিকেরা এখন সেগুলো বিক্রি করতে চান। বাকিরা অপেক্ষা করছেন দাম আরেকটু বাড়লেই তাঁরা ভূসম্পত্তি বিক্রি করে দেবেন, যাতে তাঁরা তাঁদের বিনিয়োগের অর্থ কিছুটা হলেও তুলতে পারেন। কোনো কোনো শ্যাতো কেনা দামের অর্ধেকেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
চীনাদের স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাচ্ছে মিথ্যা আশার ছলনে। লি লিজুয়ান বলেন, কিছু বিনিয়োগকারী আসলে পয়সা খরচ করে ফরাসি জীবনযাত্রা কিনেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘তাঁরা সুন্দর একটি বাড়ি কিনেছিলেন, যা হংকং কিংবা সাংহাইয়ের চেয়ে সস্তা; কিন্তু এসব ভূসম্পত্তির আর্থিক স্থিতিশীলতা কিংবা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ নিয়ে তাঁরা ভাবেননি।’
ফ্রান্সের গ্রামীণ এলাকায় বাড়ি কিনতে সহায়তা করে সেফার লোকাল কোম্পানি। তাদের মতে, অনেকের মধ্যে এক ধরনের ভুল ধারণাও ছিল। কিছু চীনা বিনিয়োগকারীর নিজ দেশেই আঙুরের বাগান ছিল; কিন্তু তারা ঠিকমতো ধারণা করতে পারেনি যে বড় একটি বাগান পরিচালনা করতে কত বেশি খরচ হতে পারে। একই ভাবে চীনের বাজারে দামি ওয়াইন বিক্রি করাও যে কঠিন হতে পারে, সে সম্পর্কেও তাদের ধারণা ছিল না।
কোভিড মহামারির পর থেকে চীনে ওয়াইন পান কমে গেছে। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাজেশন অব ভাইন অ্যান্ড ওয়াইনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালেই ওয়াইনের ভোগ কমেছে ২৫ শতাংশ। এরপর ফ্রান্সে শিলাবৃষ্টি ও ছত্রাকের মতো রোগের সমস্যা রয়েছে। এসব কারণে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পেতে অনেক বছর লেগে যায়। ফলে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহে ভাটা পড়ে।
হংকংয়ের ঋণদাতা হুগো তিয়ান বলেন, ‘ইউরোপিয়ানরা প্রজন্মের কথা চিন্তা করে। অন্যদিকে চীনাদের ভাবনায় থাকে পাঁচ বছরের একটি হিসাব। এরপর বিক্রি করে দেওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা।’
দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প
লি লিজুয়ান একমত। তিনি মনে করেন, সমস্যা জটিল হওয়ার মূল কারণ ‘ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায়ী সংস্কৃতি’। এর পাশাপাশি রয়েছে, ব্যবস্থাপনায় কিছু দিন পরপরই পরিবর্তন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন টেকনিক্যাল ম্যানেজার এএফপিকে বলেন, তিনি তাঁর সাবেক বসকে চার বছরে মাত্র একবার দেখেছেন; কিন্তু তিনি অসম্ভব সব দাবি নিয়ে এসেছিলেন। আঙুরলতার যে জীবনচক্র রয়েছে, তা বিবেচনা না করেই তিনি সেসব দাবি করেছিলেন।
তবে কিছু কিছু চীনা বিনিয়োগকারী ঠিকই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছেন।
চীনা ই–কমার্স গ্রুপ আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা কোটিপতি ব্যবসায়ী জ্যাক মা এমনই একজন। তিনি অন্ত্রে দ্যু মারে অবস্থিত সোরস বাগানের পুনর্গঠনের জন্য শত শত কোটি ডলার খরচ করেছেন। হংকংয়ের ব্যবসায়ী পিটার কোওক তাঁর সাতটি অবহেলিত বাগানের পেছনে লম্বা সময়ের জন্য অর্থ ঢালছেন। এসব বাগানের একটিতে তৈরি হয় বিরল সঁ–এমিলিয় গ্রান্ড ক্রু ক্লাস ওয়াইন।
হংকংয়ের হুগো তিয়ান শ্যাতো ফশে দামি ওয়াইন ক্যাডিলাক কোতস দ্য বোর্দো তৈরি করেন। তিনিও তাঁর সম্পত্তি বিক্রি করছেন না। তিনি বলেন, তিনি মূলত কম বয়স্ক চীনা ভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে মধ্যম থেকে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করছেন, কারণ এসব ভোক্তা প্রাকৃতিক ও অর্গানিক ওয়াইন পছন্দ করেন।
হুগো তিয়ান বলেন, ‘আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই নতুন চীনা বিনিয়োগকারী আসবে। তাঁরা অনেক বেশি যুক্তিবাদী ও বাস্তব বোধসম্পন্ন হবেন।’