নতুন ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে স্টার্টআপের ধারণা এখন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। ছোট পরিসর থেকে শুরু করে অনেক স্টার্টআপ এখন বিলিয়ন বা শতকোটি ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। যেসব স্টার্টআপ শতকোটি ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়, তাদের সাধারণত ইউনিকর্ন নামে অভিহিত করা হয়।
স্টার্টআপ মূলত উদ্ভাবনী ভাবনা থেকে জন্ম নেওয়া নতুন উদ্যোগ। তারা মানুষের বাস্তব সমস্যার সহজ সমাধান দেওয়ার মাধ্যমে বিকশিত হয়। শুরুতে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা থাকলেও সঠিক দিকনির্দেশনা, প্রযুক্তি ও দলগত প্রচেষ্টা স্টার্টআপকে টেকসই ব্যবসায় পরিণত করতে পারে।
বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন প্রতিবছর সম্ভাব্য কিছু স্টার্টআপের তালিকা দিয়ে থাকে, কিছুদিনের মধ্যে যাদের শতকোটি ডলারের কোম্পানি বা ইউনিকর্ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। শর্ত হচ্ছে, সেগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ও ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে। এবারের তালিকায় এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক স্টার্টআপের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। এদের মধ্যে শীর্ষ ১০ স্টার্টআপ কারা হতে পারে, তা দেখে নেওয়া যাক। ফোর্বস ম্যাগাজিন যে ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে, তা সাধারণত ভুল হয় না।
এরা স্বাস্থ্য খাতে কাজ করে থাকে। স্বাস্থ্য খাতের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সহায়তা করা এদের কাজ। এসব যন্ত্রপাতি তৈরিতে রোগীদের তথ্য দরকার; যে তথ্য চিকিৎসকদের হাতে সংরক্ষিত থাকে। সিনক্রেনের মতো কোম্পানি তাদের খদ্দের। এই কোম্পানি মানুষের মস্তিষ্কের চিকিৎসার জন্য যে ক্লিনিক্যাল প্রাক্–পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, সেই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য এই অ্যাকুইটি এমডির কাছ থেকে নিয়ে থাকে। এ ছাড়া ইন্টেলিজয়েন্ট নামের আরেকটি কোম্পানি হাঁটু প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন সার্জিক্যাল যন্ত্রের বিপণনে তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে থাকে।
বিপণনের জগতে এখন ইউটিউব ইনফ্লুয়েন্সারদের ভূমিকা অনেক বেশি। বাজারে এমন অনেক ইনফ্লুয়েন্সার আছেন। কিন্তু কোন ইনফ্লুয়েন্সারকে ব্যবহার করলে ভালো ফল হবে, সেটা ঠিক করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এজেন্টিওর কাজ ঠিক সেটাই। বাজারে যে ইনফ্লুয়েন্সাররা আছেন, তাঁদের তথ্যভান্ডার থাকে এদের কাছে। এতে কনটেন্ট নির্মাতাদেরও সুবিধা। বাস্তবতা হলো, এই নির্মাতারা এজেন্টিওতে তাদের পরবর্তী ভিডিওর বিষয়ে তথ্য দিয়ে থাকেন। সেখান থেকে বিজ্ঞাপনদাতারা দেখেন, কোন কনটেন্টে বিজ্ঞাপন দেওয়া যায়। উবার, মিন্ট মোবাইল ও অ্যাওয়ের মতো কোম্পানি এজেন্টিওর কাছ থেকে এই সেবা নিয়ে থাকে।
পৃথিবীতে এখন চলছে মহাকাশ দখলের প্রতিযোগিতা। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সামরিক—সব ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তারের জন্য মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা আছে। বিষয়টি হলো, মার্কিন সামরিক বাহিনী এবং অ্যামাজন ও স্পেস এক্সের মতো কোম্পানিগুলো নিম্ন-কক্ষপথে হাজার হাজার ছোট স্যাটেলাইট পাঠানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক অ্যাপেক্সের কাজ হচ্ছে, এই প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত ও কম খরচে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা। সে জন্য তারা স্যাটেলাইট তৈরি করছে, যেখানে ক্রেতারা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেন্সর ও যন্ত্রপাতি যুক্ত করতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানটি শুরুতেই সফলতা পেয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সঙ্গে ৪৬ মিলিয়ন বা ৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের চুক্তি করেছে।
দারুণ এক উদ্ভাবনী সেবা নিয়ে এসেছে এই অ্যাসর্ট হেলথ। হাসপাতালে সিরিয়াল পেতে রোগীদের অনেক ক্ষেত্রেই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। বিষয়টি বিরক্তিকর। সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক এই স্টার্টআপ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে টেক্সট থেকে ভয়েস বার্তা রূপান্তর করছে। সেই ভয়েস বা কণ্ঠস্বর রেকর্ড থাকে। তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর চাহিদার সঙ্গে ডাক্তারের সময় মিলিয়ে সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে। এই সফটওয়্যারের কারণে লাখ লাখ মানুষের অপেক্ষার সময় কমেছে। চেসাপেকি হেলথকেয়ার ও পেনিনসুলা অর্থোপেডিক অ্যাসোসিয়েটসের মতো কোম্পানি এই সেবা নিচ্ছে।
বেসিসও আরেক উদ্ভাবনী সমাধান নিয়ে এসেছে। নিউইয়র্কভিত্তিক এই প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান এআইভিত্তিক হিসাবরক্ষণের সফটওয়্যার তৈরি করেছে। এই সফটওয়্যার কয়েক মিনিটের মধ্যে বিপুল পরিমাণ প্রশাসনিক কাজ করতে পারে। রসিদ থেকে তথ্য নেওয়ার মতো ডেটা এন্ট্রির কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে এই সফটওয়্যার। ২০২৪ সালে এই সফটওয়্যার ব্যবহার শুরু করার পর হিসাবরক্ষণ ফার্ম উইস জানিয়েছে, এ ধরনের কাজের সময় প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। সফটওয়্যারের আরও একটি বড় সুবিধা হলো, এর নিরাপত্তাব্যবস্থা। এটি সংবেদনশীল তথ্য সংরক্ষণ করে না।
এখন এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। এআই অনেক কাজ সহজ করে দিচ্ছে, কিন্তু এআই ঠিক কতটা নির্ভুল উত্তর দিচ্ছে, তা পরিমাপ করবে কে? সেই সমাধান নিয়ে এসেছে ব্রেইনট্রাস্ট। কোনো বিশেষ চ্যাটবট ঠিক কতটা সঠিক উত্তর দিচ্ছে, তার হিসাব রাখে এই ব্রেইনট্রাস্ট। তাদের খদ্দেরদের মধ্যে আছে এয়ারটেবল, ইনস্টাকার্ট, নোশন ও স্ট্রাইপ। এই কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ৩৫ বছর বয়সী অঙ্কুর গয়াল এর আগে ইমপিরা নামের সার্চ ইঞ্জিন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
প্রযুক্তি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে ব্রাউজারকেও বিদায় বলার সময় এসেছে কি না, তা নিয়েও ভাবার অবকাশ তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেটের সঙ্গে মানুষের আচার–আচরণ বা ব্যবহার কেমন হবে, তা বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে এই ব্রাউজারবেজ। ইন্টারনেটের মহাসমুদ্রে ডুব দিয়ে ক্লিক করা, স্ক্যান করা বা তথ্য খোঁজার চেয়ে এখন বরং এআই সব কাজ করে দিচ্ছে। এই ধারণাকে বলা হচ্ছে হেডলেস ব্রাউজার (ব্যবহারকারী দেখতে পায় না, কিন্তু ওয়েবপেজ চলে)। বিষয়টি এ রকম—ধরা যাক, আপনি ঢাকা থেকে কাতারের রাজধানী দোহায় যাবেন, উড়োজাহাজের টিকিট দরকার; ব্রাউজার বেজে সেই অনুরোধ লিখে টাইপ করে দিন, এআই আপনাকে সেরা সমাধান দেবে।
২০১২ সালে সুরভি সারনা ওভারিয়ান ক্যানসারবিষয়ক স্টার্টআপ এন ভিশন স্টার্ট মেডিকেলের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে গিয়ে ৫ লাখ ডলার জোগাড় করতেই গলদঘর্ম হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি এটি ২৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারে বিক্রি করে দেন। পরবর্তী পাঁচ বছর ওয়াই কমবিনেটরের অংশীদার হিসেবে কাজ করার পর সারনা সহজেই কোলেটের জন্য ৩ কোটি ডলারের প্রাথমিক তহবিল সংগ্রহ করেন। কোলেটের লক্ষ্য হলো, জীববিজ্ঞান সংস্থাগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্বয়ংক্রিয় করার কাজে এআই ব্যবহার করা, যেমন চিকিৎসাসংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও এফডিএর অনুমোদন–সংক্রান্ত কাগজপত্র। কয়েক মাসের কাজ তারা এখন কয়েক দিনের মধ্যেই করতে পারছে। ফলে কোম্পানির বিকাশও হচ্ছে তর তর করে।
২৭ বছর বয়সী টোমার কোহেন এবং ২৬ বছর বয়সী বেন উইলির বিশ্বাস, ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হবে সাধারণ কথ্যভাষা। তাঁদের স্টার্টআপ ডেভিড এআই বড় বড় প্রযুক্তি সংস্থাকে ১৫টি ভাষায় প্রায় ১ লাখ ঘণ্টা উচ্চমানের ভয়েস রেকর্ড সরবরাহ করেছে। এই কণ্ঠ দিয়ে চৌকস এআই মডেল তৈরি করা হচ্ছে। ফলে এআই মডেলগুলোর কথ্যভাষা বোঝার সক্ষমতা বাড়ছে। তাদের কৌশলও খুব সহজ–সরল। সেটা হলো, মানুষকে তাঁরা টাকা দিচ্ছেন; এর বিনিময় তাঁরা কণ্ঠ রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
ডিন লেইটারসডর্ফ বড় লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন। সেটা হলো, ওপেনএআই, অ্যানথ্রোপিক ও গুগলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো বড় আকারের এআই ল্যাব তৈরি করা। দেকার্ত নামকরণ করা হয়েছে ১৭ শতকের ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের নামে। দেকার্তের বিখ্যাত উক্তি ‘আই থিংক, দেয়ারফোর আই অ্যাম’, অর্থাৎ চিন্তা করি বলেই আমি আছি। ২৬ বছর বয়সী কম্পিউটারবিজ্ঞানী ডিন লেইটারসডর্ফ মনে করেন, এআই সম্পর্কে বলতে গেলে এখন এই একটি বাক্যই যথেষ্ট। এই অ্যাপ মূলত রিয়েল টাইম জেনারেটিভ এআই তৈরি করে।