ট্রাম্প ২.০ জমানার শুরু। এর সঙ্গে আবারও শুরু হয়েছে বাণিজ্যযুদ্ধ। ইতিমধ্যে চীনের পণ্যে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। মেক্সিকো ও কানাডার সব পণ্যেও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এই দেশগুলোও বসে নেই, তারা পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে।
কিন্তু ট্রাম্পের এই ‘ট্যারিফোনমিক্স’ কি এত সহজ হবে? শুল্ক বাড়লে আমদানি করা জিনিসের দামও বাড়বে। সেই কারণে লোকে বিদেশি পণ্য কেনা তাৎপর্যপূর্ণ হারে কমালে শুল্ক বাবদ রাজস্ব কমেও যেতে পারে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া এখনকার দিনে অর্থনীতি ও উৎপাদনপ্রক্রিয়া এমনভাবে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে এক দেশের পক্ষে আরেক দেশকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
বাণিজ্যযুদ্ধ কী
বাণিজ্যযুদ্ধ বলতে মূলত বোঝানো হয় এমন এক অবস্থাকে, যেখানে একটি দেশ আরেকটি দেশের ক্ষতি করতে পণ্যের ওপর বিভিন্ন শুল্ক আরোপ ও কোটা সীমাবদ্ধতা প্রয়োগ করে। ফলে একসময় শুরু হয় রাজনৈতিক টানাপোড়েন। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, একটি দেশ প্রথমে অন্য আরেকটি দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক আরোপ করবে। তারপর সেই দেশ শুল্ক আরোপ করা দেশটির পণ্যেও একই ধরনের শুল্ক আরোপ করে—এভাবেই ‘ইটের বদলে পাটকেল নীতি’র বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাণিজ্যযুদ্ধ। মূলত বাণিজ্যযুদ্ধের উদ্দেশ্য অনেক রকম হতে পারে। যেমন কোনো দেশ অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য–ঘাটতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে বা শত্রুরাষ্ট্রের অর্থনীতির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে কোনো রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে এই যুদ্ধের সূচনা করতে পারে।
শিল্পবিপ্লবের পর থেকে যতই সময় অতিবাহিত হয়েছে, ততই অস্ত্র আর বোমার বিধ্বংসী শক্তিকে পরাস্ত করে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের নানা প্রান্তের দেশগুলো মনোযোগ দিয়েছে শিল্প-বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশে। একটি বিষয় সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছে। সেটা হলো, যে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি যত শক্তিশালী, পৃথিবীজুড়ে তার প্রভাবও তত বেশি। বর্তমান যুগে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে তার অর্থনীতির উত্থান ঠেকিয়ে দেওয়ার চেয়ে বড় হাতিয়ার আর কিছুই হতে পারে না। এ ছাড়া যুদ্ধ হলে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় উভয় পক্ষকে। সেই তুলনায় সামরিক যুদ্ধে না জড়িয়ে শত্রুরাষ্ট্রকে শায়েস্তা করার অন্যতম কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে বাণিজ্যযুদ্ধ।
বাণিজ্যযুদ্ধের পেছনের কারণ
সম্প্রতি বাণিজ্যযুদ্ধ শব্দটি সবার মুখে মুখে ঘোরার পেছনের কারণ হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন, কানাডা ও মেক্সিকোর বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন। এপ্রিল মাসে আরও অনেক দেশের পণ্যেই তিনি শুল্ক আরোপ করবেন। মূলত ট্রাম্প এই ঘোষণা দিয়েছেন বিদ্যমান বাণিজ্য–ঘাটতি মেটাতে। এটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির একটি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান তিনটি বাণিজ্য অংশীদার হচ্ছে কানাডা, মেক্সিকো ও চীন। এই তিন দেশের সঙ্গে তাঁর বড় ধরনের বাণিজ্য–ঘাটতি আছে। ২০২৪ সালে কানাডার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য–ঘাটতি ছিল ৬৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৩৩০ কোটি ডলার; মেক্সিকোর সঙ্গে বাণিজ্য–ঘাটতি ছিল ১৭১ দশমিক ৮ বিলিয়ন বা ১৭ হাজার ১৮০ কোটি ডলার; ২০২৩ সালে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য–ঘাটতি ছিল ২৭৯ বিলিয়ন বা ২৭ হাজার ৯০০ কোটি ডলার।
বাণিজ্যযুদ্ধের পেছনের আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, এই দেশগুলোর তাদের বাজার যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যের জন্য খোলা রাখেনি। কিন্তু তার বিপরীতে এসব দেশের অধিকাংশ পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে যা বৈষম্যমূলক মনে হয়েছে। এ ছাড়া মুদ্রার অবমূল্যায়নের মাধ্যমে সুবিধা আদায় করে নেওয়া, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরি ও সরকারি ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে চীন নিজের কোম্পানিগুলোকে কম মূল্যে পণ্য উৎপাদনের সুযোগ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরির অভিযোগও আছে মার্কিন প্রশাসনের।
বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব
বড় ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ সচরাচর দেখা যায় না। এর আগে দেখা গিয়েছিলে ১৯৩০ সালে। সে বছর অর্থনৈতিক মন্দা সামাল দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপ করে স্মুট অ্যান্ড হিউলি অ্যাক্ট, ১৯৩০ প্রয়োগের মাধ্যমে। ফলে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে পাল্টা আক্রমণ করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ধস নামে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে। ফলে দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্র স্মুট অ্যান্ড হিউলি অ্যাক্ট, ১৯৩০ বাতিল করে আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সেই বাণিজ্যযুদ্ধ কাজে আসেনি। কিন্তু ২০১৬ সালে চীনের সঙ্গে যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার জেরে চীনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য–ঘাটতি অনেকটাই কমেছে। ২০১৬ সালে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য–ঘাটতি ছিল ৩৪৭ বিলিয়ন বা ৩৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। ২০২৩ সালে যা ২৭৯ বিলিয়ন বা ২৭ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ঘাটতি কমেছে প্রায় ৭ হাজার কোটি ডলার।
আরেকটি বিষয় হলো, কোভিডের পর থেকে যে চীনের প্রবৃদ্ধি কমে আসছে, তার অন্যতম কারণ এই বাণিজ্যযুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র শুধু শুল্ক আরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পশ্চিমা দেশগুলোর সম্মিলিত সিদ্ধান্তের কারণে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো চীন থেকে পণ্য উৎপাদন সরিয়ে নেয়। ফলে চীনের প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির কথা বলে হুয়াওয়ের মতো কোম্পানির বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগে। পরিণামে স্মার্টফোনসহ প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় তারা একসময় পিছিয়ে পড়ে। যদিও চীন সম্প্রতি বৈদ্যুতিক গাড়িসহ এআই প্রযুক্তিতে অনেকটা উন্নতি করেছে। এমনকি তারা যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে।
তাতে অবশ্য ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ উপকৃত হয়েছে। অ্যাপলের মতো কোম্পানি ভারতে উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। চীনের প্রবৃদ্ধির গতি কমলেও ভারতের বেড়েছে। ভিয়েতনামেও বেড়েছে উৎপাদন। যদিও জানা যায়, ভিয়েতনামের অনেক কোম্পানিতে গোপন চীনা বিনিয়োগ আছে। ফলে চাইলেই চীনকে একেবারে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এমনকি ট্রাম্প এত চীনবিরোধী হলেও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় চীনে তৈরি পণ্য ব্যবহৃত হয়েছে—এমন খবরও পাওয়া গেছে।
ভিয়েতনাম উচ্চ প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়ায় তাদের তৈরি পোশাকের বাজার বাংলাদেশও কিছুটা পেয়েছে। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়ছে, এটা তার অন্যতম কারণ।
বিশ্বায়ন ও বাণিজ্যযুদ্ধ
বিষয়টি হলো, যন্ত্রের ব্যবহারে উৎপাদন বাড়ে, অনেক মানুষ চাকরি হারায়। অনেক মানুষ অর্থনৈতিক সংকটের কবলে পড়ে। তবে সাধারণ মানুষকে বোঝানো সহজ করতে জনতুষ্টিবাদী নেতারা যন্ত্রের বদলে বিদেশিদের ঘাড়ে দোষ চাপান। তাঁরা অভিবাসীদেরও দোষ দেন, যদিও অভিবাসীরা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির জন্য উপকারী হতে পারেন। স্বল্প মেয়াদে পরিবর্তনের কারণ হিসেবে তথা স্থানীয় জনগণের চাকরি হারানোর কারণ হিসেবে অভিবাসীদের দায়ী করা সহজ হয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত এই স্লোগান তুলে জনপ্রিয়তা পান। তাঁর ভাষ্য ছিল, বিশ্বায়নের কারণে চীনে সব কারখানা চলে গেছে, তাই মার্কিন নাগরিকেরা কাজ পাচ্ছেন না। এবার তিনি যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করবেন, তাঁদের বিশেষ ছাড়ও দেওয়া হবে।
মানুষ যখন প্রথম আফ্রিকা ছেড়ে অন্য জায়গায় বসবাস শুরু করে, তখনই বিশ্বায়ন শুরু হয়। আজকের যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই এই অভিবাসনের ফল। কিন্তু যেসব মানুষ আগে এসেছিল, তারা নতুন আসা অভিবাসীদের বিষয়ে সব সময় অভিযোগ করত—তারা চাকরি নিয়ে নিচ্ছে বা তাদের সংস্কৃতি আলাদা। এখনো ঠিক একই বিষয় ঘটছে।
যখন অভিবাসন বেড়ে যায় (অথবা সংবাদমাধ্যমে অভিবাসনের খবর অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হয়), তখন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যাওয়া স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশে জনতুষ্টিবাদী নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে অভিবাসনকেই মূল ইস্যু বানিয়েছেন। ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে এই ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০২৪ সালেও ইস্যুটি বড় ভূমিকা রেখেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) হয়তো সমাজে আরও বড় পরিবর্তন আনছে। কিন্তু এগুলো চোখে দেখা যায় না। তাই জনগণকে ভয় দেখানোর জন্য এগুলোর বদলে অভিবাসীদের দোষ দেওয়া সহজ।
অনেকেই মনে করেন, প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশে জনতুষ্টিবাদীদের উত্থানের কারণ হলো বিশ্বায়নের দ্রুত বিস্তার। আর জনপ্রিয় নেতারা দেশের সমস্যার জন্য বিদেশি বাণিজ্য ও অভিবাসনকে দায়ী করেন। তবে বিশ্বায়নের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশের মানুষেরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। কোম্পানিগুলোর ক্ষতি হয়নি, তারা চীনে, ভিয়েতনামে বা অন্যান্য দেশে বিনিয়োগ করে নতুন নতুন বাজারে ঢুকেছে। তাদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে ঠিক, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে কারখানা বন্ধ হওয়ায় অনেক মানুষের চাকরি গেছে। ফলে তাঁরা সামাজিক নিরাপত্তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ বৃদ্ধির পেছনে এটাও অন্যতম কারণ।
স্নায়ুযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও অভিবাসন অনেক বেড়েছিল। উন্নত প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে দেশগুলোর মধ্যে অর্থ, পণ্য ও মানুষের চলাচল সহজ হয়। কিন্তু এখন জনতুষ্টিবাদী নেতাদের প্রভাব বাড়ায় অনেক দেশ শুল্ক ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কঠোর করছে। ফলে অর্থ, পণ্য ও মানুষের চলাচল সীমিত হচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিশ্বায়ন কি পুরোপুরি থামিয়ে দেওয়া সম্ভব? ইতিহাস বলে, হ্যাঁ, এটা হতে পারে। উনিশ শতকে বাণিজ্য ও অভিবাসন দ্রুত বাড়ছিল, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হঠাৎ তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯১৪ সালের আগের বাণিজ্যের মাত্রায় ফিরে যেতে প্রায় ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছিল।
এখন কিছু আমেরিকান রাজনীতিবিদ চীনের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার পক্ষে কথা বলছেন। তাহলে কি এটা আবার ঘটতে পারে? যদিও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য কিছুটা কমতে পারে, তবে বছরে অর্ধট্রিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যমানের এই সম্পর্ককে ত্যাগ করলে অনেক মূল্য দিতে হবে। তাই বিচ্ছিন্নতা সম্ভবত ঘটবে না। তবে ‘সম্ভব নয়’-এর মানে কিন্তু একেবারে ‘অসম্ভব’ নয়। উদাহরণস্বরূপ, তাইওয়ান নিয়ে যুদ্ধ হলে মার্কিন-চীন বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ঘাটতি নিয়ে কেন এত চিন্তা
বাণিজ্য–ঘাটতি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এত মাথাব্যথা কেন, যে তিনি একরকম সারা পৃথিবীর বাণিজ্যব্যবস্থা ওলট–পালট করতে চাচ্ছেন। ট্রাম্প পেশায় ব্যবসায়ী, তিনি মনে করেন, বাণিজ্য–ঘাটতিতে দেশের ক্ষতি। কিন্তু জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান নিয়ে সামান্য হিসাব করলেই নির্ধারণ করা যায়, দেশে যদি আমদানির অর্থমূল্য রপ্তানির চেয়ে বেশি হয়, তার অর্থ হলো, দেশের সরকার বা নাগরিকেরা আয় বা কর সংগ্রহের তুলনায় বেশি ব্যয় করছেন। অর্থাৎ সেই দেশের জাতীয় সঞ্চয় তাদের জাতীয় বিনিয়োগের চেয়ে কম। ফলে দেশে বাণিজ্য–ঘাটতি হলে বহির্বিশ্ব থেকে ঋণ করতে হবে ঘাটতি মেটাতে। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ঠিক তা–ই করছে। দেশটির জাতীয় ঋণ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে গত দুই বছরে দেশটির কংগ্রেসে একাধিকবার অচলাবস্থা তৈরি হয়। আংশিক শাটডাউনের মুখেও পড়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩৯ সালে প্রথম জাতীয় ঋণসীমা নির্ধারিত হয় ৪৫ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। এরপর এখন পর্যন্ত ১০৩ বার এই ঋণসীমা বাড়াতে হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে দেশটির জাতীয় ঋণ অনুমোদিত সীমার ৯৮ শতাংশে উঠে যায়, ২০০১ সালে যা ছিল মাত্র ৩২ শতাংশ। বর্তমানে এই সীমা ৩৩ লাখ কোটি ডলার।
২০১৬ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প ধনীদের করছাড় দিয়েছিলেন। এরপর কোভিডের সময় মানুষকে প্রণোদনা দিতে মার্কিন সরকারকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিতে হয়েছে। সে কারণে গত কয়েক বছরে মার্কিন সরকারের ঋণ অনেকটা বেড়েছে। এখন ট্রাম্প আবার ধনীদের ছাড় দিলে রাজস্ব আয় কমবে। তার সঙ্গে ইসরায়েল-হামাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও ইউক্রেনকে বিপুল পরিমাণে সহায়তা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। ফলে ট্রাম্প যে যুদ্ধ অর্থায়ন বন্ধের অঙ্গীকার করেছিলেন, মানুষ তাতে সমর্থন দেয়। সে দেশের মানুষও বুঝতে পেরেছে, এভাবে চলতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে বিপদই ছিল। এমনও হতে পারত, আর্থিকভাবে তারা চীনের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়ত।
যাহোক, জাতীয় সঞ্চয় হলো দেশের নাগরিকদের সঞ্চয় আর সরকারি সঞ্চয়ের যোগফল। নাগরিকদের সঞ্চয় হলো তাঁদের আয় থেকে কর ও ব্যয় বাদ দিয়ে যা উদ্বৃত্ত থাকে, সেই অঙ্ক। কর সংগ্রহের পর সরকারি ব্যয় বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে, তা হলো সরকারি সঞ্চয়, যাকে বলা হয় বাজেট উদ্বৃত্ত। গত ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকার নাগরিকদের ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের হার কর প্রদানের পর অবশিষ্ট আয়ের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৫ সালের পর থেকেই এই সঞ্চয়ের হার নিম্নগামী। ২০২৪-এ সরকারি বাজেট–ঘাটতির হার জাতীয় আয়ের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, যা গত ৫০ বছরের গড় বাজেট–ঘাটতির প্রায় দ্বিগুণ।
জাতীয় সঞ্চয়ের এই মৌলিক ঘাটতির সমস্যা বিবেচনা না করে ট্রাম্প আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে এক ঢিলে বহু পাখি মারার কথা ভাবছেন। একদিকে যেমন বিভিন্ন দেশকে বিভিন্ন কারণে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা, তেমনি ট্রাম্প আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে সরকারি বাজেট–ঘাটতি পূরণ করার কথাও ভাবছেন, যাতে আয়কর বাড়াতে না হয়। তিনি মনে করছেন, আমদানি শুল্ক আরোপ করা হলে দেশের শিল্প চাঙা হবে। এমনকি কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে উৎপাদনকেন্দ্র তৈরি করলে তারা আমদানি শুল্কসহ অন্যান্য কর ছাড় পাবে।
সরকারি বাজেট–ঘাটতি কমানোর জন্য দুটি পথ খোলা আছে, কর বাড়ানো বা সরকারি ব্যয় কমানো। প্রথম পথটি ট্রাম্প অবশ্যই নেবেন না, কারণ, তিনি ভোটারদের করহ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরপর রইল দ্বিতীয় পথ। নির্বিচারে ব্যয় কমানো সরকারি সঞ্চয় বাড়ানোর চটজলদি পথ। ট্রাম্প সরকারের আয়তন কমাচ্ছেন। চাকরি হারাচ্ছেন অনেক সরকারি কর্মী।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় বিশ্বাস করেন না। তাঁর কাছে এই পৃথিবী মানেই হারজিতের মাঠ। আমদানি শুল্ক ট্রাম্পের কৌশলগত অস্ত্র। তবে এই অস্ত্রের প্রভাব আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী হতে পারে। চীন হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক হ্রাস করে এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে হাঁটার কথা ভাবছে, ট্রাম্পের পরিবেশ দূষণরোধের অসহযোগিতা আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। এখনো ট্রাম্প ভারতের ওপরে বিশেষ আমদানি শুল্ক আরোপ করেননি, যদিও হুমকি দিচ্ছেন। সে রকম কিছু ঘটলে ভারতও চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে পারে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বর্তমান চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ কারও জন্যই সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন না। এতে শেষমেশ অর্থনীতির প্রবাহ ব্যাহত হয়। ফলে এই যুদ্ধে শেষমেশ কেউ জেতে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বিশাল বাণিজ্য–ঘাটতি রয়েছে। তবে তার জবাব কখনোই বাণিজ্যযুদ্ধ হতে পারে না। আলোচনার টেবিলে বসেই এর সমাধান করাই শ্রেয়, বাণিজ্যযুদ্ধের ডামাডোল পেটানোর চেয়ে।
সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।