বিশ্ববাজারে তেলের দাম বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে, দেশে কমে না কেন

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের অন্যতম মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬২ ডলারে নেমে এসেছে। আরেক মানদণ্ড ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম নেমে এসেছে ৫৮ ডলার ৩৩ সেন্টে। এটি জানুয়ারির মাসের জন্য আগাম দাম, গত এক মাসের মধ্যে যা সর্বনিম্ন।

চলতি বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেকটা কমলেও দেশের বাজারে তার তেমন প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। নানাবিধ কারণেই তা হচ্ছে।

বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম আরও কমার সম্ভাবনা আছে। কেননা, নিকট ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে জোগান আরও বাড়তে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধান নিয়ে সম্প্রতি নতুন উদ্যোগ ফলপ্রসূ হওয়ার আশা দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধবিরতি হয়, তাহলে বাজারে রাশিয়ার তেলের সরবরাহ আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে যুদ্ধবিরতির যে আশা তৈরি হয়েছে, তাতেও বাজারে তেলের জোগান বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র দেখা যাচ্ছে, তাতে আগামী ডিসেম্বর মাসে ফেডারেল রিজার্ভ আবারও নীতি সুদহার কমাতে পারে। সেই সঙ্গে পশ্চিমা পৃথিবীতে বড়দিনের উৎসবের মৌসুম আসছে। এই পরিস্থিতিতে চাহিদা বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। সম্প্রতি তেলের দাম নিয়ে ২০২৬ সালে পূর্বাভাস দিয়েছে অয়েলপ্রাইসডটঅর্গ, তার সঙ্গেও এই পরিস্থিতি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এদিকে ওপেক ও সহযোগী দেশগুলোর বৈঠক হবে কিছুদিন পর। এই বৈঠকের কারণে বাজারে অনিশ্চয়তার আরও একটি মাত্রা যোগ হয়েছে। সেটা হলো, উৎপাদন কোটা বা কৌশল নিয়ে কোনো ইঙ্গিত আসে কি না, বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। ধারণা করা হচ্ছে, সংস্থাটি প্রথম প্রান্তিকের উৎপাদননীতি বা ২০২৬ সালের সামগ্রিক উৎপাদন লক্ষ্যে পরিবর্তন আনবে না। অর্থাৎ বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ থাকবে।

দাম ৮১ ডলার থেকে ৬১ ডলারে

অয়েলপ্রাইসডটঅর্গের তথ্যানুসারে, নভেম্বর মাসজুড়েই ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারের ঘরে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম ছিল ১১ নভেম্বর। সেদিন দাম ছিল ৬৫ ডলার ১১ সেন্ট।

চলতি বছরের শুরুতে অর্থাৎ ১ জানুয়ারি বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ছিল ৭৪ ডলার ৬৪ সেন্ট। এ বছর তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে গত ১৬ জানুয়ারি। ওই দিন ব্যারেলপ্রতি ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ৮১ ডলার ২৯ সেন্টে উঠে যায়। এ বছর তেলের দাম সর্বনিম্ন ৬১ ডলার ৭০ সেন্ট পর্যন্ত নেমেছে।

বিশ্ববাজারে সাধারণত অন্যান্য অপরিশোধিত তেলের দামও এই ব্রেন্ট ক্রুড ও ডব্লিউটিআই ক্রুডের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। সেগুলোর দাম এর আশপাশেই থাকে।

বাংলাদেশে কেন প্রভাব পড়ছে না

বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারেও এখন প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। করোনার সময় থেকেই কয়েক দফায় তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে দেশে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো হচ্ছে। কিন্তু দেশের বাজারে নিয়মিত দাম সমন্বয় করা হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম হ্রাসের তেমন একটা প্রভাব পড়ছে না।

এর মূল কারণ হলো, ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়া। ২০২২ সালের শুরুতে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১২২ টাকা। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব তেমন একটা পড়ছে না। এ ছাড়া সরকার সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কেনে। যখন চুক্তি হয়, তখন সে অনুযায়ী তেল পাওয়া যায়, তা সে বিশ্ববাজারে তেলের দাম যা-ই হোক না কেন। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হওয়ার কারণে পরবর্তী সময়ে দাম কমলেও চুক্তির দামই পরিশোধ করতে হয়।

জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে অনেক কিছুর সম্পর্ক আছে। তেলের দাম বাড়লে পরিবহন, শিল্প, কৃষি ও বিদ্যুৎ—সবকিছুর ব্যয় বেড়ে যায়। কেবল বাংলাদেশই নয়, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও বিপদে পড়েছিল। সারা বিশ্বেই তখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি শুরু হয়। অন্যান্য দেশ সেখান থেকে বেরিয়ে এলেও বাংলাদেশ এখনো সেই চক্রে আটকে আছে, যদিও সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে।