ইউয়ানের অস্থিরতায় চীনারা রপ্তানি আয় ধরে রাখছে ডলারে

চীনের মুদ্রা ইউয়ানের দাম কমে যেতে পারে—এই অনুমান থেকে অনেক চীনা কোম্পানি তাদের রপ্তানি আয় ডলারে ধরে রাখছে, আবার অনেকে নিজেদের ঝুঁকি কমাতে অন্যান্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। কোম্পানির নির্বাহী, ব্যাংকার ও বিভিন্ন ডেটা বিশ্লেষণ করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই খবর দিয়েছে।

চীনের বেশ কয়েকজন ব্যাংকার রয়টার্সকে বলেন যে গ্রাহকেরা তাঁদের রপ্তানি আয় স্থানীয় মুদ্রায় পরিবর্তন করতে অনাগ্রহী। অন্যদিকে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩০টির মতো বড় কোম্পানি ঝুঁকি কমাতে বিদেশি মুদ্রায় চুক্তি করার মতো ব্যবস্থা নিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে চীনের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ডলারে রাখা আমানত ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বেড়ে ৮৮ হাজার ৭৮০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এটি একটি বড় পরিবর্তন, কারণ, গত বছরগুলোয় ডলারে রাখা আমানতের পরিমাণ কমছিল।

ব্যবসায়ীদের এই পদক্ষেপ অবশ্য ব্যাংকগুলোর পূর্বাভাসের সঙ্গে মিলছে না। ধারণা করা হয়েছিল ২০২৩ সালে ইউয়ান শক্তিশালী হবে। বাজারে এমন প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছিল যে মার্কিন ডলারের দাম এ বছর কমবে। কিন্তু ডলারে আয় ধরে রাখার বিষয়টি সম্ভবত ইউয়ানের মূল্যমানের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।

সাংহাই-ভিত্তিক ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম রপ্তানিকারক মিজ ঝু বলেন, তিনি ডলার সরিয়ে রাখছেন। প্রতিবছর তিনি যা আয় করেন, তার মধ্যে ৭০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ আয় আসে মার্কিন মুদ্রায় এবং সরিয়ে রাখা এই আয় তাঁর ব্যবসার মুনাফার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে তিনি মনে করেন।

নিজের পুরো নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঝু বলেন, ‘স্থানীয় সরবরাহকারী ব্যক্তিদের দাম চুকাতে হয়তো আমাকে কিছু ডলার ইউয়ানে পরিবর্তন করতে হবে। (কিন্তু) আমি অনুভব করছি কিছু ডলার আমাকে হাতে রাখতে হবে, কারণ, ইউয়ানের দাম আরও কমে যাবে।’

চায়না সাদার্ন এয়ারলাইন্সের মতো আরও অনেক প্রতিষ্ঠান মনে করে যে চীনা মুদ্রার জন্য সামনের দিনগুলো মসৃণ হবে না।

উড়োজাহাজের সংখ্যার বিবেচনায় চীনের সবচেয়ে বড় এই বিমান পরিবহন কোম্পানি ২৮ ফেব্রুয়ারি স্টক একচেঞ্জকে জানিয়েছে যে ২০২৩ সালে ঝুঁকি কমাতে তারা ৪০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ মুদ্রার অগ্রিম চুক্তি করবে। এটি গত বছর ছিল ৮৫ কোটি ডলারের সমপরিমাণ।

বেইজিং হঠাৎই শূন্য কোভিড নীতি থেকে সরে আসার পর ইউয়ানের দাম ওঠানামার প্রেক্ষাপটে সম্ভবত এই পদক্ষেপ খুব আশ্চর্যের কিছু নয়। জানুয়ারিতে চীনা মুদ্রার দাম গত ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে উঁচুতে ওঠে। তবে এরপর এর দাম কমে ডলারপ্রতি প্রায় সাত ইউয়ানের পর্যায়ে নেমে আসে।

ডলারের সবশেষ দাম ছিল ৬ দশমিক ৯০ ইউয়ান। ডলারের দাম সাত ইউয়ানের নিচে নেমে যাওয়ার বিষয়ে ফ্রাক্সে পাঠানো এক প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়না তাদের গভর্নরের একটি মন্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ওই মন্তব্যে গভর্নর ই গ্যাঙ বলেন, সাত ইউয়ানের স্তরটি আসলে ‘কোনো মনস্তাত্তিক প্রতিবন্ধক’ নয়।

ই গ্যাঙ বলেন, পাঁচ বছর ধরে মুদ্রার দাম ওঠানামা করছে। এই ওঠানামা ৪ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। আর এই ওঠানামার হারের সঙ্গে অন্যান্য বড় অর্থনীতির সামঞ্জস্যও রয়েছে। সব মিলিয়ে ইউয়ানের বিনিময় হার একটি যৌক্তিক পর্যায়ে স্থিতিশীল থাকবে।

১৯৯৪ সালে আনুষ্ঠানিক ও খোলাবাজারের বিনিময় হার এক করার পর ইউয়ানের জন্য ২০২২ সাল ছিল সবচেয়ে খারাপ বছর। এ সময় সুদের হার বাড়ার কারণে ডলারের দাম বাড়ে। ফলে ইউয়ানের দাম প্রায় ৮ শতাংশ পড়ে যায়।

এখন বিদেশ ভ্রমণে চীনারা আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করবে এই সম্ভাবনা বাড়ছে। অন্যদিকে এমন উদ্বেগও জোরদার হচ্ছে যে মার্কিন সুদের হার আরও বাড়বে এবং ভূরাজনৈতিক কারণে চীন থেকে বিনিয়োগ অন্যত্র চলে যাবে—এসব কারণে ইউয়ানের ওপর চাপ বাড়ছে।

কমার্জ ব্যাংকের চীনবিষয়ক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ টমি উ বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে এটা সম্ভব যে ইউয়ান অদূর ভবিষ্যতে আবার সাত–এর ঘর অতিক্রম করবে। তবে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান যদি এটা দেখাতে পারে যে অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে, তাহলে ইউয়ান স্থিতিশীল হতে পারে।

গতকাল রোববার চীন চলতি বছরের জন্য ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। অর্থনীতির পুনরুদ্ধার যদি একই গতিতে চলতে থাকে, তাহলে তা ইউয়ানের জন্য সমর্থন জোগাবে ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে।

চীনা কর্তৃপক্ষ ইউয়ানকে সমর্থন দিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং এই মুদ্রাকে নিয়ে বাজি ধরা ব্যয়বহুল করে তুলেছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে বাজারে আর হস্তক্ষেপ আশা করা হচ্ছে না। ২০২২ সালের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন মুদ্রার দামের নিম্ন ও ঊর্ধ্ব সীমা ঠিক করে দেবে, এমনটাও মনে করা হচ্ছে না।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ডলারের দাম আগামী জুন পর্যন্ত সাত ইউয়ানের পর্যায়ে থাকবে। তবে বছর শেষে ইউয়ান শক্তিশালী হবে এবং প্রতি ডলারের দাম তখন দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৭ ইউয়ান।