যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে বাড়ছে ‘ভৌতিক চাকরি’ বিজ্ঞাপন
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে অনলাইনে প্রকাশিত চাকরির বিজ্ঞাপনের প্রায় ২২ শতাংশই ছিল ভৌতিক।
যুক্তরাষ্ট্রে ‘দ্য ট্রুথ ইন জব অ্যাডভারটাইজিং অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ।
শুনতে গল্পের মতো লাগলেও ‘ঘোস্ট জব বা ভৌতিক চাকরি’ বলতে বোঝায় এমন চাকরির বিজ্ঞাপন, যেগুলোর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এ ধরনের ভৌতিক চাকরির বিজ্ঞাপন বাড়ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বৈশ্বিক গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়োগ-সংক্রান্ত সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান গ্রিনহাউসের এক গবেষণায় জানা যায়, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে অনলাইনে প্রকাশিত চাকরির বিজ্ঞাপনের প্রায় ২২ শতাংশই ছিল ভৌতিক। চাকরিপ্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে কাজ করে যুক্তরাজ্যের এমন একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশটিতে চাকরির বিজ্ঞাপনের ৩৪ শতাংশই ভৌতিক।
যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিএলএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্টে দেশটিতে চাকরির শূন্য পদ ছিল ৭২ লাখ, কিন্তু নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র ৫১ লাখ মানুষ। প্রশ্ন উঠছে—যদি সত্যিই এত শূন্যপদ থাকে, তবে নিয়োগ কেন এত কম হচ্ছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পেছনে বড় কারণ হতে পারে ‘ঘোস্ট জব’। এই সমস্যাটি সামনে আনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন প্রযুক্তি খাতে কর্মরত চাকরিপ্রার্থী এরিক থম্পসন। গত বছরের অক্টোবরে একটি স্টার্টআপ থেকে চাকরি হারান তিনি। পরবর্তী দুই মাসে শত শত চাকরিতে আবেদন করেও কোনো সাড়া পাননি।
এরিক থম্পসন বলেন, ‘আমি নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানানসই, এমনকি বেশি ও কম অভিজ্ঞতার পদেও আবেদন করেছি। ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, অনেক বিজ্ঞাপিত চাকরির কোনো অস্তিত্বই নেই।’ এই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ভুয়া চাকরির বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার দাবিতে একটি দল গঠন করেন। পরে কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে ‘দ্য ট্রুথ ইন জব অ্যাডভারটাইজিং অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন।
প্রস্তাবিত এই আইনে নিয়োগ বন্ধ বা সম্পন্ন হলে চাকরির বিজ্ঞাপনের মেয়াদ শেষ করার বাধ্যবাধকতা, নিয়োগপ্রক্রিয়ার যাচাইযোগ্য নথি সংরক্ষণ এবং ভুয়া বা বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন দিলে নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানের কথা বলা হয়েছে। থম্পসনের আশা, কংগ্রেসের কিছু সদস্য এই বিলের পৃষ্ঠপোষক হবেন।
এ ছাড়া তিনি একটি অনলাইন পিটিশন শুরু করেছেন, যেখানে ইতিমধ্যে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ স্বাক্ষর করেছেন। থম্পসনের ভাষায়, অনেকে তাঁকে বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছেন, ভৌতিক চাকরির কারণে তাঁদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়েছে এবং মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি ও ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের আইনসভাও ‘ভৌতিক চাকরি’ নিষিদ্ধ করার বিষয়টি বিবেচনা করছে। তবে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে কানাডার অন্টারিও প্রদেশ। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে সেখানে নিয়োগকর্তাদের বাধ্যতামূলকভাবে জানাতে হবে—কোনো বিজ্ঞাপিত পদে সত্যিই নিয়োগপ্রক্রিয়া চলছে কি না।
অন্টারিও একই সঙ্গে ‘রিক্রুটমেন্ট ঘোস্টিং’ সমস্যার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে। অনেক সময় কোম্পানি প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর আর কোনো উত্তর দেয় না। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, প্রদেশটিতে ২৫ জনের বেশি কর্মী আছে—এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাক্ষাৎকার নেওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে প্রার্থীকে উত্তর দিতে হবে। তবে যাঁদের সাক্ষাৎকারই নেওয়া হয়নি, তাঁদের ক্ষেত্রে উত্তর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। টরন্টোভিত্তিক শ্রম আইনজীবী ডেবোরাহ হাডসন বলেন, ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে নিয়মকানুন ঠিকভাবে মানার জন্য।
ডেবোরাহ হাডসনের ভাষায়, ‘প্রায় ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সরকার আসলেই কীভাবে এটি নজরদারি করবে—সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। প্রয়োজনীয় সম্পদ না থাকায় অনেক নিয়োগকর্তাই হয়তো নিয়ম না মেনেও পার পেয়ে যাবে। তবে কেউ অভিযোগ করলে, সেটি তদন্তের আওতায় আসবে।’
কানাডার অন্য প্রদেশগুলোয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এখনো চাকরিপ্রার্থীদের উত্তর দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। যুক্তরাজ্যে বর্তমানে ভৌতিক চাকরি বন্ধে কোনো আইনগত উদ্যোগ নেই। যুক্তরাজ্যের লেস্টার শহরের বাসিন্দা ও চাকরিপ্রার্থী আইলিশ ডেভিস বলেন, ছোট প্রতিষ্ঠান হোক বা বড় করপোরেশন—সব জায়গা থেকেই কোনো উত্তর না পাওয়া তাঁর কাছে ‘মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়ার মতো’ অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, একটি আবেদন ঠিকভাবে সাজাতে আমি যে পরিমাণ সময় ও শ্রম দিই, তারপরও কোনো সাড়া না পাওয়া খুব হতাশাজনক। এটা মানুষকে ভেঙে দেয়।
১০ বছরের বেশি সময় ধরে বিপণন পেশায় কাজ করা আইলিশ ডেভিস একটি ঘটনার কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, একবার একজন নিয়োগ ব্যবস্থাপক তাঁর কাছে সাক্ষাৎকারের জন্য সময় জানতে চেয়েছিলেন। তিনি সময় জানিয়ে উত্তর দেওয়ার পর আর কোনো যোগাযোগই করা হয়নি। আইলিশ ডেভিসের মতে, বর্তমান চাকরির বাজার মোটেও স্বস্তিকর নয়। তাই নিয়োগকর্তাদের উচিত চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে আরও মানবিক ও সহানুভূতিশীল আচরণ করা।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিভিত্তিক ক্যারিয়ার কোচ ও নিয়োগ বিশেষজ্ঞ জ্যাসমিন এসকালেরা জানান, তিনি মূলত যেসব নারী ক্যারিয়ার কোচিং করতেন, তাঁদের মাধ্যমেই প্রথম ‘ঘোস্ট জব’ সমস্যার কথা জানতে পারেন। জ্যাসমিন এসকালেরা বলেন, তাঁরা দেখতেন একই চাকরির বিজ্ঞাপন বারবার প্রকাশিত হচ্ছে এবং আমাকে জিজ্ঞেস করতেন—আবার আবেদন করা উচিত কি না। বাস্তবে তাঁরা যেন একধরনের ‘কালো গহ্বরে’ আবেদন পাঠাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, এভাবে বারবার কোনো সাড়া না পেলে যেকোনো চাকরিপ্রার্থীর মনোবল ভেঙে পড়ে।