কার্যালয় বন্ধ, বাড়ি থেকে কাজের নির্দেশ—যা ঘটছে ভারতের বাইজুসকে নিয়ে

বড় ধরনের বিপদে রয়েছে ভারতের শিক্ষাবিষয়ক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান বাইজুস। পরিস্থিতি এত সঙিন যে তারা প্রধান কার্যালয় রেখে বাকি সব কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে এবং ১৪ হাজার কর্মীকে ঘর থেকে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছে।

এনডিটিভির সংবাদে বলা হয়েছে, খরচ বাঁচাতে বাইজুস এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত আসেনি। যেসব কার্যালয়ের চুক্তির মেয়াদ গত কয়েক মাসে শেষ হয়েছে, সেগুলোর মেয়াদ তারা আর বৃদ্ধি করেনি। এই প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রধান কার্যালয় ছাড়া বাকি সব কার্যালয় ছেড়ে দিচ্ছে বাইজুস।

২০১৮ সালে বাইজু রবীন্দ্রনের শিক্ষাপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বাইজুস ভারতের শীর্ষ স্টার্টআপগুলোর মধ্যে একটি ছিল। করোনা মহামারির সময় স্কুল যখন বন্ধ ছিল, তখন বাইজুসের আরও বাড় বাড়ন্ত হয়। কিন্তু এই সবকিছুই এখন সোনালি অতীত।

একসময় বাইজুসের বাজারমূল্য ছিল ২০ বিলিয়ন বা দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। কিন্তু বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকরকের তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি বাইজুসের বাজারমূল্য এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। ভারতের সবচেয়ে দামি স্টার্টআপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় বাইজুস; এমনকি পেটিএমকেও ছাড়িয়ে যায় তারা। একসময় ভারতীয় ক্রিকেট দলের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব পায় এই স্টার্টআপ; কিন্তু এরপরই ধাক্কা খায় তারা।

বাইজুস ক্ষতির মুখে পড়ে, বাড়তে থাকে ঋণের বোঝা—এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরাও কোম্পানিকে চেপে ধরে।

ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল বাইজুস। কিন্তু স্পনসরশিপের দায়বদ্ধতা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় এবং ১৫৮ কোটি রুপি বকেয়া পরিশোধ না করায় ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই) বাইজুসের বিরুদ্ধে মামলা করে।

কর্মচারীদের বেতন দিতে না পারায় সম্প্রতি নিজের বসতবাড়িও বন্ধক রাখতে হয়েছে বাইজু রবীন্দ্রনকে। নিতে হয়েছে ঋণ। কিছুদিন আগে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডির তল্লাশিও হয়েছে তাঁর বাড়িতে। তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশি মুদ্রা পরিচালনা আইন (ফেমা) ভাঙার অভিযোগ উঠেছে।

এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি ভারতের আর্থিক অপরাধ সংস্থা ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট’ (ইডি) রবীন্দ্রনকে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নোটিশ জারি করে। ৯ হাজার ৩০০ কোটি রুপি সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা সন্দেহজনকভাবে লেনদেন করার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

এই পরিস্থিতিতে চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাইজুসের মূল প্রতিষ্ঠান থিংক অ্যান্ড লার্নের (টিঅ্যান্ডএল) বেশির ভাগ অংশীদার অব্যবস্থাপনা ও ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে রবীন্দ্রনকে বিশেষ সাধারণ সভার (ইজিএম) মধ্য দিয়ে প্রধান নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের পক্ষে ভোট দেন।

রবীন্দ্রন ও তাঁর পরিবার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন; তাঁরা ভোটের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের দাবি, এই ভোট প্রতিষ্ঠানের আইন লঙ্ঘন করেছে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, ইজিএমে প্রতিষ্ঠানের আইন অনুযায়ী কমপক্ষে একজন প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক উপস্থিত থাকতে হবে। পরের দিন কর্মীদের কাছে এক চিঠিতে রবীন্দ্রন এই সভাকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দেন এবং এই সিদ্ধান্ত আদালতে চ্যালেঞ্জ করেন।

কর্ণাটক হাইকোর্ট এই মামলার শুনানি চলার সময় পর্যন্ত ইজিএমে পাস করা প্রস্তাবের বাস্তবায়ন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে।

চলতি বছরে এই আইনি জটিলতা হলেও অতীতে আরও বিভিন্ন আইনি জটিলতা ও আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। ২০২৩ সালেই বাইজুস ক্রমবর্ধমান ঋণ, বিনিয়োগকারী ও ঋণদাতাদের মামলা, ভারতের আর্থিক অপরাধ সংস্থার তদন্ত, হাজার হাজার কর্মচারীকে ছাঁটাই করা, দেরিতে কর্মচারীদের বেতন দেওয়া ও তারল্য–সংকটের মতো পরিস্থিতির মুখে পড়ে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে টিঅ্যান্ডএল ২০২২ সালে ৮ হাজার ২৩০ কোটি রুপি ক্ষতির কথা জানায়। তবে তারা এখনো ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন দিতে পারেনি।

বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি গ্রাহকেরাও বাইজুসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছেন। তাঁরা বলেছেন, যে কোর্স নেওয়ার সামর্থ্য তাঁদের নেই, সেই কোর্স নিতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ এনেছেন গ্রাহকেরা। কিন্তু ২০২১ সালে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে খারিজ করে দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।

চলতি মার্চ মাসে এখনো কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি বাইজুস। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, মামলা চলছে, তাই এই সময়ে প্রতিষ্ঠানের তহবিল ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এক মাস আগেই প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছিল, অর্থের অভাবে তাদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

২০১১ সালে অনলাইন টিউটরিং ফার্ম হিসেবে বাইজুসের যাত্রা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে ভারতে স্কুল শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে জোর দিয়েছে তারা। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা শেখার অ্যাপ চালু করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম আরও বেশি বিস্তৃত করে। বাইজুসের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে শিক্ষামূলক বিষয়বস্তুসংক্রান্ত ট্যাবলেট, এসডি কার্ড ও ল্যাপটপের মতো হার্ডওয়্যার বিক্রির মাধ্যমে।

২০২১ সালে ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে বিপুল অর্থ ব্যয় করার পাশাপাশি আকাশ, টপপ্র, এপিক ও গ্রেট লার্নিংয়ের মতো শিক্ষাপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো অধিগ্রহণ করে বাইজুস।

শূন্য থেকে শুরু করা বলতে যা বোঝায়, বাইজু রবীন্দ্রনের গল্পও ঠিক তেমন। উল্কার গতিতে উত্থান হয়েছিল তাঁর; এখন সম্ভবত পতন হচ্ছে তার চেয়েও দ্রুতগতিতে।