চীনের বৈদ্যুতিক গাড়িতে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত ইউরোপের ক্ষতির কারণ হতে পারে
চীনের অর্থনীতির রাশ টানতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপও চীনে উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়িতে অতিরিক্ত শুল্কারোপ করেছে। কিন্তু বিশ্বায়নের এ যুগে উৎপাদন-শৃঙ্খল এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে এ সিদ্ধান্ত শেষমেশ ইউরোপের জন্যই বুমেরাং হতে পারে।
বিষয়টা হলো বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ, ফক্স ওয়াগনের মতো বিখ্যাত গাড়ি কোম্পানিগুলো চীনে গাড়ি উৎপাদন করছে। ফলে চীনে উৎপাদিত গাড়িতে অতিরিক্ত শুল্কের কোপ তাদের ওপরই পড়বে। ঠিক সে কারণে ইউরোপের এই অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করছে জার্মানি। খবর ইউরো নিউজের।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ এরই মধ্যে বলেছেন, ইইউর বাড়তি শুল্ক আরোপ দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক হতে পারে। বিশেষ করে জার্মানির কর্মসংস্থানের ওপর তার প্রভাব পড়তে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতা ও অতিরিক্ত শুল্কের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও ব্যয়বহুল হয়। আমরা নিজেদের বাজার বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য বন্ধ করি না। এর প্রতিক্রিয়ায় আমাদের কোম্পানিগুলো এমন কিছুর সম্মুখীন হোক, সেটা আমরা চাই না।’
এক মাসের কম সময় আগে ওয়াশিংটন চীনের বিদ্যুৎ-চালিত গাড়িতে শুল্কহার চার গুণ করার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যেই ইউরোপীয় কমিশন জানিয়ে দিল, চীন যে এসব গাড়ি উৎপাদনে অতিরিক্ত ভর্তুকি দেয়, তা মোকাবিলায় ইউরোপও অতিরিক্ত শুল্কারোপ করবে। বিওয়াইডি কোম্পানির গাড়িতে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে এসএআইসি কোম্পানির গাড়িতে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কারোপ করা হবে। এর আগে গাড়িতে যে ১০ শতাংশ প্রমিত কর ছিল, তার ওপর নতুন এই কর আরোপ করা হবে।
সংবাদে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় কমিশনের এই সিদ্ধান্তের ফলে বিএমডব্লিউ, ফক্স ওয়াগন ও মার্সিডিজ বেঞ্জের মতো জার্মান গাড়ি কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চীনে কারখানা করা হলে সে দেশের সরকার ভর্তুকি দেয়, ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোও সেই সুবিধা পেয়ে আসছে। এর মধ্যে আছে সস্তা জমি, তুলনামূলক শিথিল করনীতি ও অন্যান্য আইনি সুবিধা।
এখন ইউরোপের শুল্কের বিপরীতে চীন প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিলে ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হতে পারে, যেমনটা হয়েছিল ট্রাম্পের জমানায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তখন এমন হতে পারে যে চীন এত দিন ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে যেসব সুবিধা দিয়েছে, তা প্রত্যাহার করে নেবে।
সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, জার্মান অটোমোবাইল কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগ গাড়ি এখন চীনে উৎপাদিত হয়—এই বাস্তবতায় ইউরোপ-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হলে তাদের বিক্রি কমে যেতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানি তেলনির্ভর গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যও এই সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইলেকট্রিক কার স্কিমের সিইও থম গ্রুট বলেন, ২০৩৫ সালের মধ্যে শতভাগ ইভির লক্ষ্য পূরণ করতে চাইলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। কারণ, ইভির ৫৭ শতাংশ ব্যাটারি আসে চীন থেকে।
সিএমসি মার্কেটের প্রধান বাজার বিশ্লেষক জোখেন স্ট্যানজল বলেন, চীনের গাড়ি কোম্পানিগুলোর ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজের পায়েই কুড়াল মেরেছে। এই সিদ্ধান্তের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জার্মানি। সে জন্য তারা এর বিরোধিতা করছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাজনীতিবিদেরা চীনের বৈদ্যুতিক গাড়িকে নিজেদের অটোমোবাইল শিল্পের জন্য হুমকি মনে করছেন। ইইউ আপাতত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চীন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কার্যকর সমাধান না হলে আগামী ৪ জুলাই থেকে চীনা উৎপাদনকারীদের শুল্ক বাবদ বাড়তি অর্থ গুনতে হবে। গত অক্টোবরে শুরু হওয়া ইউরোপীয় কমিশনের তদন্তে যারা সহযোগিতা করছে, তাদের জন্য শুল্কহার হবে ২১ শতাংশ। যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি, তাদের জন্য শুল্কহার ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ। এর সঙ্গে বিদ্যমান শুল্ক যোগ হলে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশের বেশি।
এদিকে রয়টার্সের আরেক সংবাদে বলা হয়েছে, চীনের অটোমোবাইল খাত মনে করছে, ইউরোপীয় কমিশনের এ সিদ্ধান্তে তাদের ওপর বিশেষ প্রভাব পড়বে। এ রকম সিদ্ধান্ত যে আসতে পারে, সে বিষয়ে তাদের আগে থেকেই ধারণা ছিল। অর্থাৎ তাদের পূর্বপ্রস্তুতি আছে।