কাঁচামালের সংকট, বিক্রি কম, দুশ্চিন্তায় উদ্যোক্তারা

ডলার–সংকটে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে।অন্যদিকে বাজারে পণ্য বিক্রি কমেছে ২০-২৫ শতাংশ। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্ববাজারে বিভিন্ন শিল্পের প্রাথমিক কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়। দেশেও ডলার–সংকট প্রকট হতে থাকে। তাতে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলা কমে যায়। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যের বিক্রি কমে গেছে। আবার চলতি মাসেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এতে সংকটে পড়েছেন দেশের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন খাতের অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।

এই খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের কাঁচামালের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তারপরও বাজারে সংকট। কারণ, ডলার–সংকটে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র আগের মতো খুলছে না ব্যাংকগুলো। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। আবার স্থানীয় বাজারে প্লাস্টিক পণ্যের বিক্রিও কমেছে ২০-২৫ শতাংশ। এতে ছোটদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিছু কারখানা বন্ধও হয়েছে।

বাজারে কাঁচামালের সংকট তৈরি হয়েছে। তাতে সবাই সমস্যায় পড়েছে। তার ওপর বিক্রি কমে যাওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি।
সামিম আহমেদ, সভাপতি, বিপিজিএমইএ

দেশে প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী তৈরির ইতিহাস একবারে নতুন নয়। ষাটের দশকে অল্পবিস্তর গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হতো। তখন ভারত ও চীন থেকে প্রয়োজনীয় প্লাস্টিক পণ্য আমদানি করা হতো। তবে আশির দশকে এসব পণ্য উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। নব্বইয়ের দশকে পোশাক খাতের জন্য হ্যাঙ্গার, পলিব্যাগ, বোতামসহ বিভিন্ন উপকরণ তৈরির মধ্য দিয়ে প্লাস্টিকশিল্পে বিপ্লব শুরু হয়। প্রচ্ছন্ন এই (সরাসরি নয়) রপ্তানির পরপরই মূলত চাহিদা অনুযায়ী অন্যান্য পণ্যসামগ্রীও উৎপাদন করতে থাকেন উদ্যোক্তারা।

কেরানীগঞ্জে ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করা আমান প্লাস্টিকের কারখানায় গাড়ি, মোটরসাইকেল, উড়োজাহাজ, খেলনা পিস্তল, ফিশিং গেম, গিটারসহ বিভিন্ন ধরনের খেলনা তৈরি হয়। কাঁচামাল আমদানির জন্য আগে মাসে গড়ে দুটি ঋণপত্র খুলত প্রতিষ্ঠানটি। তবে ডলার–সংকটে তারা একটি ঋণপত্র খুলতে পারছে এখন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে আমান প্লাস্টিকের স্বত্বাধিকারী মো. আমান উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৩-৪ শতাংশ। কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৩৫-৪০ শতাংশ। ঋণপত্রও খোলা আগের চেয়ে অর্ধেক কমেছে। বিক্রিও ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তাতে ৩০ শতাংশ উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। আগামী ঈদের আগে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে হতে পারে।

আমান উল্লাহ আরও বলেন, কুটির ও ছোট উদ্যোক্তারা স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল কিনে থাকেন। মাঝারি ও বড় উদ্যোক্তারা সরাসরি আমদানি করেন। ঋণপত্র খোলা কমে যাওয়ায় বাজারে কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে। তাই কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত করতে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ আগের জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। না হলে শুধু এই কারণেই ছোট কারখানা বন্ধ হবে। অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন ও বিপণন হয়। সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে ৫ হাজারের বেশি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার ছোট, ১ হাজার ৪৮০টি মাঝারি এবং ৫০টি বড় কারখানা। ৪ হাজার ৯৮০টি ছোট-মাঝারি কারখানায় কাজ করেন ৬ লাখের বেশি মানুষ।

জানতে চাইলে বিপিজিএমইএর সভাপতি সামিম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীই কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে সমস্যায় পড়ছেন। বাজারে কাঁচামালের সংকট তৈরি হয়েছে। তাতে সবাই সমস্যায় পড়েছে। তার ওপর বিক্রি কমে যাওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে সামিম আহমেদ বলেন, পুরান ঢাকার ছোট-মাঝারি উদ্যোক্তাদের সমস্যা আরও বেশি। সেখানকার দেড় হাজার কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ দাবি করে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করছে না সিটি করপোরেশন। পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিচ্ছে না। তাতে ব্যাংকঋণ নিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। সার্বিকভাবে ছোট-মাঝারি উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।