নেটফ্লিক্স কিনছে ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে, হলিউডে দাপট বাড়বে

প্রথম আলো গ্রাফিকস

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ প্রযোজনা কোম্পানি ওয়ার্নার ব্রাদার্স কিনে নিচ্ছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স। এ নিয়ে হলিউডের অভিনেতা ও কলাকুশলীরা চিন্তিত।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশঙ্কা, এটা একধরনের অভ্যুত্থান। অনেক কর্মী কাজ হারাবেন। কলাকুশলী ও শিল্পীদের আয়রোজগার কমে যাবে।

স্টার্টআপ হিসেবে যাত্রা শুরু করা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সকে একসময় কেউ তেমন একটা পাত্তা দিত না। কিন্তু এখন তাদের প্রভাব–প্রতিপত্তি এত বেড়ে গেছে যে ওয়ার্নার অ্যান্ড ব্রাদার্সের মতো প্রযোজনা কোম্পানি ৭২ বিলিয়ন বা ৭ হাজার ২০০ কোটি ডলারে কিনে নিচ্ছে তারা।

এই পরিস্থিতিতে হলিউডের স্ক্রিপ্ট লেখকদের সংগঠনের প্রতিনিধিত্বকারী রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা গতকাল শুক্রবার বলেছে, বিশ্বের বৃহত্তম স্ট্রিমিং কোম্পানি তার অন্যতম বৃহৎ প্রতিযোগীকে কিনে নিচ্ছে, এটা তো হতে পারে না। অ্যান্টি–ট্রাস্ট আইন তো সে জন্যই করা হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, এ কারণে কনটেন্টের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য কমে যাবে। সামগ্রিকভাবে বিনোদনকর্মীদের জীবনমানের অবনতি ঘটবে।

ওয়ার্নার ব্রাদার্স বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, প্যারামাউন্ট বা কমকাস্টের মতো প্রযোজনা সংস্থা তা কিনে নেবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে নেটফ্লিক্স তা কিনে নিচ্ছে। এ নিয়ে হলিউডের কর্মীরা রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

কিন্তু ওয়ার্নার ব্রাদার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডেভিড জাসলাভ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন নন। তিনি বরং বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন। বলেছেন, এই শিল্পে একধরনের প্রজন্মগত পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে বিনোদনজগতে বড় কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে।

হলিউডের শিল্পী ও কলাকুশলীরা এই অধিগ্রহণের বিষয়ে শঙ্কিত।
রয়টার্স

বিষয়টি এমন নয় যে এ ঘটনার আগে হলিউড ভালো অবস্থায় ছিল। কয়েক বছর ধরেই হলিউডের লেখক ও কলাকুশলীরা নানা ধরনের আন্দোলন সংগ্রাম করছেন। ২০১০-এর দশকেই স্টুডিওর সংখ্যা কমতে থাকে। কমতে থাকে চলচ্চিত্রের সংখ্যা। এরপর কোভিড মহামারির সময় কাজ তো কয়েক মাস বন্ধই ছিল। এ কারণে অনেক স্টুডিও তখন কাজ বাতিল বা স্থগিত করে। বিধিনিষেধের সময় সিনেমা হলগুলো রীতিমতো অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যায়। এখনো তাদের দর্শকসংখ্যা প্রাক্‌-কোভিড পর্যায়ে পৌঁছেনি। সেই সঙ্গে খরচ কমাতে ও কর ছাড় পেতে অনেক সিনেমা ও টিভি সিরিজের উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে চলে গেছে।

সবকিছুর শানে নজুল হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বিনোদন অর্থনীতির সংকোচন হয়েছে। অনেক মানুষের আশঙ্কা, ওয়র্নার ব্রাদার্স নেটফ্লিক্সের হাতে গেলে মানুষের কাজ আরও কমে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রযোজকদের গিল্ড বিবৃতিতে বলেছে, এই সম্ভাব্য অধিগ্রহণ চুক্তির বিষয়ে প্রযোজকদের যে আশঙ্কা, তা ঠিকই আছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই যে এত এত পুরোনো স্টুডিও, সেগুলো তো কেবল অভিলেখাগার নয়; বরং সেগুলো জাতির সংস্কৃতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আধার।

বিপন্নতা কোথায়

হলিউডের শিল্পীদের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন এসএজি-আফট্রাও শঙ্কা প্রকাশ করেছে। তাদের ভাষ্য, এ ঘটনায় বিনোদনশিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক গুরুতর প্রশ্নের উদয় হয়েছে। বিশেষ করে প্রতিভাবান মানুষের জীবিকা ও ক্যারিয়ার এর ওপর নির্ভর করে।

মোদ্দাকথা, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের এ উত্থানের কারণে সিনেমা হলগুলো বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ হাজার সিনেমা হলের সংগঠন সিনেমা ইউনাইটেড বিবৃতিতে বলেছে, প্রেক্ষাগৃহগুলো অভূতপূর্ব হুমকির মুখে পড়বে।

সিনেমা ইউনাইটেডের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী মাইকেল ও লিয়েরি বিবৃতিতে বলেন, এই চুক্তির মধ্যে নেটফ্লিক্স বলেনি, তারা বড় প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করবে। সেখানে বরং তার উল্টোটা ঘটছে। তাঁর আহ্বান, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। প্রেক্ষাগৃহ, বিনোদনশিল্প ও ভোক্তাদের ওপর কী প্রভাব পড়বে, সেই বিষয়টি তাদের গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত।

যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ার্নার ব্রোসের একটি স্টুডিও
রয়টার্স

নেটফ্লিক্স যা বলছে

চলচ্চিত্রশিল্প–সংশ্লিষ্টদের মূল অভিযোগ, নেটফ্লিক্স বড় পর্দায় চলচ্চিত্র মুক্তি দেবে না। কিন্তু নেটফ্লিক্স এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, চলতি বছর তারা এ পর্যন্ত ৩০টি চলচ্চিত্র বড় পর্দায় মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে চলবে বা শুধু সেখানেই চলবে, এই ধারণার বিরোধী তারা। নেটফ্লিক্স মনে করে, এটা গ্রাহকবান্ধব নয়।

অন্যদিকে ওয়ার্নার অ্যান্ড ব্রাদার্স নেটফ্লিক্সের হাতে চলে গেলে ব্যাটম্যান, হ্যারি পটার, ক্যাসাব্লাঙ্কা ও দ্য উইজার্ড অব ও জেডের মতো চলিচ্চত্র তাদের হাতে চলে আসবে। সেই সঙ্গে গেম অব থ্রোনসের মতো মর্যাদাপূর্ণ টিভি সিরিজের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে আসবে। এর মধ্য দিয়ে যা হবে তা হলো, ডিজনির পর নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী এইবিও ম্যাক্সের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অধিগ্রহণের কারণে ভোক্তারা যে উপকৃত হবেন, তা–ও নয়। নেটফ্লিক্স ইতিমধ্যে মাশুল বাড়িয়েছে। বিজ্ঞাপন বৃদ্ধির সঙ্গে পাসওয়ার্ড ভাগাভাগির ব্যবস্থাও সীমিত করেছে তারা। এই বাস্তবতায় ওয়ার্নারের মতো বৃহৎ প্রযোজনা কোম্পানি তাদের হাতে এলে ভোক্তাদের খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি বিকল্পও সীমিত হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রশিল্প সংকুচিত হবে। কর্মী ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা যেমন আছে, তেমনি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে।

এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একদল প্রযোজক কংগ্রেসের হস্তক্ষপের আহ্বান করেছেন। তাঁদের শঙ্কা, এর মধ্য দিয়ে হলিউড বড় সংকটে পড়বে। বিনোদনজগতে নেটফ্লিক্সের একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

মূল স্রোতেও ভাসছেন অনেকে

এর বিপরীত চিত্রও আবার আছে। মানুষ ঘরের সোফায় বসে সিনেমা দেখতে চাইলেও অনেক নির্মাতা চান, তাদের সৃষ্টি বড় প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হোক। সে কারণে স্ট্রেঞ্জার থিঙ্গসের নির্মাতা ডাফার ব্রাদার্স নেটফ্লিক্সের সঙ্গে জুটি না বেঁধে প্যারামাউন্টের সঙ্গে কাজ করছে।

এদিকে প্যারামাউন্ট সম্প্রতি টম ক্রুজ ও উইল স্মিথের মতো তারকাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে।