অর্থনীতির হাতে প্রেসিডেন্টের ভাগ্য

বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে মার্কিন অর্থনীতি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেই সফলতার ভিত্তিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প কি আবার নির্বাচিত হবেন, নাকি মার্কিন জনগণ নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনকে বেছে নেবে, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে শিগগিরই
ছবি: সংগৃহীত

১৯৯০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা গিয়েছিল, তার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র আট মাস। ১৯৯০ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ১৯৯১ সালের মার্চ পর্যন্ত। অর্থনীতি দ্রুতই সেই ক্ষত সারিয়ে উঠতে সমর্থ হলেও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ তাঁর প্রতি আস্থা ফেরাতে পারেননি। তাই এক মেয়াদের প্রেসিডেন্ট হিসেবেই আত্মতৃপ্ত হতে হয় তাঁকে। এটি তো কেবল একটি উদাহরণ, আসলে বরাবরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বড় ভূমিকা রেখেছে দেশটির অর্থনীতি। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলেও পাশার দান ঘুরিয়েছেন সে দেশের সাধারণ মানুষ বা ভোটাররা। তবে বরাবরই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বড় ভূমিকা রেখেছে নির্বাচনে।

জর্জ বুশের পুনর্নির্বাচনে হারার কারণ অর্থনীতি

একবার সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের ৪১তম প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (সিনিয়র বুশ হিসেবে পরিচিত) নিজের হারের কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার কাজ করেছি। আমার ভুলগুলো প্রকাশ করেছি। আমি মনে করি, মানুষ আমাকে পছন্দ করত। তবে তাদের মধ্যে হতাশা ছিল। তারা পরিবর্তন চেয়েছিল।’ ১৯৯০-এর দশকের যে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বুশ দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি, সেই মন্দার জন্য কোনোভাবেই বুশ দায়ী ছিলেন না। ওই মন্দার প্রভাবে মার্কিন অর্থনীতিতে বেকারত্ব বেড়ে গিয়েছিল, যা নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিশ্লেষকেরাও মনে করেন, ১৯৯০-এর মন্দার শিকার হয়েছিলেন সিনিয়র বুশ। বিশ্লেষকদের মতে, মন্দা একেবারে সময়মতো হয়েছিল, যা কাজে লাগিয়েছিল ক্লিনটন শিবির। এই মন্দা যদি এক বছর আগে বা পরে হতো, তাহলে হয়তো নির্বাচনে হারতেন না বুশ।

তবে ১৯৯২ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন কোনো বিচ্ছিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বজুড়েই ভোটাররা চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেখেই তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। এমনকি এমন অনেক ঘটনার জন্য জনগণ নেতা পাল্টান, যার দায় হয়তো সেই নেতার নয়। অর্থনীতির স্বল্পমেয়াদি প্রবণতাই নেতা বদলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেসব প্রেসিডেন্টের সময় অর্থনীতি খারাপ ছিল, তাঁদের বেশির ভাগই পুনর্নির্বাচনে জিততে পারেননি।

যে কারণে সৌভাগ্যবান বারাক ওবামা

১৯৩০ সালের মহামন্দার পর বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দা মানুষ দেখেছিল ২০০৮ সালে। যার সূচনা হয়েছিল ২০০৭ সালের শেষে। এই মন্দায় সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ছিল লেম্যান ব্রাদার্সের পতন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একসময়ের নামী এ বিনিয়োগ ব্যাংককে একনামে চিনত সারা দুনিয়া। সেখানে যাঁরা কাজের সুযোগ পেতেন, তাঁদের কদর বেড়ে যেত। লেম্যান ব্রাদার্সের পতন সে সময় বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত বয়ে আনে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের বহু দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা সংকটে পড়ে। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ রিপাবলিকান নেতা নয়, ডেমোক্র্যাট নেতা বারাক ওবামাকেই বেছে নেয়। মার্কিন ইতিহাসে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টদের অন্যতম ওবামা। পুনর্নির্বাচনে জিতে পুরো আট বছরের মেয়াদ শেষ করেন তিনি।

অতীতের তথ্য পর্যালোচনায় বলা যায়, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পুনর্নির্বাচনে জেতার বিষয়টি। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো থাকলে পুনর্নির্বাচনে জেতেন বিদ্যমান প্রেসিডেন্টরা। আর অর্থনীতি খারাপ হলে তাঁরা নির্বাচনে হারেন। আশির দশকে রোনাল্ড রিগ্যান পুনর্নির্বাচনে জিতেছিলেন, কারণ, তাঁর সময় মার্কিন অর্থনীতি বেশ চাঙা ছিল। ১৯৮১ সালে রিগ্যান প্রথম যেবার প্রেসিডেন্ট হন, সেবার জিমি কার্টার পুনর্নির্বাচনে হারেন ওই অর্থনৈতিক কারণেই।

তবে মার্কিন নির্বাচনের পুরো বিষয়টিকে এভাবে সরলীকরণ করতে রাজি নন বিশ্লেষকেরা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ১৯৯২ সালে যখন জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ হারেন, তখন অর্থনীতিতে বেকারত্ব থাকলেও প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে ওবামা যখন পুনর্নির্বাচনে জয়ী হন, তখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে কম, ২ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্লেষকেরা বলেন, বহুদিন ধরেই অর্থনীতিতে ভোক্তার আস্থা ভোটার অনুভূতি নির্ধারণের অন্যতম সেরা উপায়। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা যা–ই বলুন না কেন, ভোটাররা আশাবাদী, মানে অর্থনীতি ভালো করছে। ভোটার হতাশাগ্রস্ত, মানে অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়।

‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির জয়

২০১৬ সালে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক এই অঙ্গীকার তাঁকে নির্বাচনী লড়াইয়ে এগিয়ে দেয়। তীব্র জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ মানুষ মার্কিন অর্থনীতির শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে ভোট দেন ট্রাম্পকে। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ট্রাম্পও সেদিকে মনোযোগ দেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টিরও চেষ্টা করেছেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী করপোরেট ও ব্যক্তিগত আয়করও কমিয়েছেন। দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে পুরো অগ্রাধিকার দিয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়েছেন। ট্রাম্পের প্রথম তিন বছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে মনে করা হচ্ছিল, ট্রাম্পও হয়তো তাঁর প্রেসিডেন্সির আট বছর পার করতে পারবেন।

করোনা বদলে দিল দৃশ্যপট

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের শেষ বছরে হানা দিল করোনা। একেবারেই অপ্রত্যাশিত এই সংকট মন্দা নিয়ে এল অর্থনীতিতে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বেকারত্বের হার যেখানে রেকর্ড কমে নেমে গিয়েছিল, সেই হার এপ্রিলে রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আমেরিকার ইতিহাসে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে অনেক ব্যতিক্রম। সেই সঙ্গে প্রার্থীদের জন্য অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।