অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দৌড়ে জয়ী একমাত্র চীন

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন চলতি বছরের শেষ নাগাদ আগের মতো প্রভাবশালী রূপেই ফিরবে চীন।
ছবি: রয়টার্স

করোনার কারণে টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ খুঁজছে। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ধুঁকছে। মন্দায় পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানের মতো বড় বড় অর্থনীতি। তবে এই ধারার ব্যতিক্রমী অবস্থান নিয়েছে চীন। চীনের অর্থনীতি আবারও চলছে তার আগের গতিতে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন চলতি বছরের শেষ নাগাদ আগের মতো প্রভাবশালী রূপেই ফিরবে চীন।

গত বছরের শেষের দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে যখন করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হয় বলে ধারণা করা হয়। এই সংক্রমণ ঠেকাতে প্রথমে লকডাউন পদক্ষেপ নেয় চীন। মার্চের আগপর্যন্ত এ যেন কেবল চীনেরই মাথাব্যথা ছিল। তবে বিশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির সমস্যা তো কেবল তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। মার্চ থেকে লকডাউন সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ। দেশে দেশে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ রাখা হয় সীমানা। অর্থনৈতিক কার্যক্রম একরকম স্থবির হয়ে পড়ে। মে মাসের শেষ থেকে একটু একটু সচল হতে থাকে অর্থনীতি। তবে সেই অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পেরে মন্দায় পড়ে অনেক দেশই, যা এই বছরের শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর মধ্যে চীনই একমাত্র দেশ যারা এই প্রভাব কাটিয়ে উঠছে। আশা করছে চলতি বছর শেষে তাদের প্রবৃদ্ধি হবে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। যেখানে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী সামগ্রিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতি ৫ দশমিক ২ শতাংশ সংকুচিত হবে।

চলতি বছর শেষে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ১ দশমিক ৬ শতাংশ।
ছবি: রয়টার্স
বিশ্বব্যাংকের তথ্যউপাত্ত নিয়ে ব্যবহার করে সিএনএন বিজনেস চীনের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে। এতে তারা বলছে, এ বছরের শেষে বিশ্বব্যাপী জিডিপিতে চীনের অংশের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ১ শতাংশ বাড়তে পারে, যা ২০১৯ সালের চেয়ে তিন গুণ বেশি। বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ অংশ কমবে।

আসলে কঠোর লকডাউন এবং জনসংখ্যা ট্র্যাকিং নীতিসহ ভাইরাস দমনে নেওয়া নানা ব্যবস্থার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে চীন। সেই সঙ্গে অর্থনীতিকে ঠিক রাখতে চীন সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর জন্য কয়েক শ বিলিয়ন ডলার আলাদা করে রেখেছিল তারা। এ ছাড়া জনগণের মধ্যে ব্যয়কে উদ্বুদ্ধ করতে নগদ প্রণোদনাও দেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপের স্পষ্ট অগ্রগতি এখন দৃশ্যমান। সাপ্তাহিক ছুটিগুলোতে মানুষের ব্যয় করার প্রবণতা আবার ফিরে আসছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যউপাত্ত নিয়ে ব্যবহার করে সিএনএন বিজনেস চীনের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে। এতে তারা বলছে, এ বছরের শেষে বিশ্বব্যাপী জিডিপিতে চীনের অংশের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ১ শতাংশ বাড়তে পারে, যা ২০১৯ সালের চেয়ে তিন গুণ বেশি। বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ অংশ কমবে। অবশ্য করোনার আগে আশা করা হচ্ছিল ২০২০ সালের মধ্যে চীনের অর্থনীতির আকার দাঁড়াবে ১৪ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারে, যা বিশ্ব জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশের সমান। সে পর্যায়ে এবার যাচ্ছে না দেশটি।

অস্ট্রেলিয়ার বিনিয়োগ ব্যাংকিং কোম্পানি ম্যাককোয়ারি গ্রুপের প্রধান অর্থনীতিবিদ ল্যারি হুর মতে, ভাইরাসজনিত বাধা কাটিয়ে এই বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অংশ বৃদ্ধি পাবে। চীনের দক্ষতা বিশ্ব অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব বৃদ্ধিতে ত্বরান্বিত করছে। হু বলেন, চীনের পুনরুদ্ধার বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে।

গত সপ্তাহে ‘বার্ষিক গোল্ডেন উইকের’ ছুটি উদ্‌যাপন করেছে চীনের মানুষ।
ছবি: রয়টার্স

গোল্ডেন উইক বুম

আসলে চীনের পুনরুদ্ধার পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে গত সপ্তাহটি ছিল টার্নিং পয়েন্ট। করোনার পর চীনের অর্থনৈতিক উন্নতি গত সপ্তাহের মতো এত স্পষ্ট আগে হয়নি। গত সপ্তাহে ‘বার্ষিক গোল্ডেন উইকের’ ছুটি উদ্‌যাপন করেছে চীনের মানুষ। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার দিবসসহ চন্দ্র উৎসবও ছিল এই গোল্ডেন উইকে। এ সময় দেশের অভ্যন্তরেই ব্যাপক ভ্রমণ করেছেন চীনের মানুষেরা। দেশটির সংস্কৃতি ও পর্যটন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার শেষ হওয়া এই গোল্ডেন উইকে এবার প্রায় ৬৩ কোটি মানুষ দেশের ভেতরেই ভ্রমণ করেছেন, যা গত বছরের একই সময়ের ভ্রমণের প্রায় ৮০ শতাংশ। ইতিমধ্যে পর্যটকদের ব্যয়ও গত বছরের স্তরের প্রায় ৭০ শতাংশ ফিরে এসেছে, ৭ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে। সিনেমার টিকিট বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫৮ কোটি ডলারের, যা গত বছরের রেকর্ড থেকে মাত্র ১২ শতাংশ কম। হু বলেন, চীনের মূল ভূখণ্ডে জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে, বিশেষত পরিষেবা গ্রহণ আগের অবস্থায় ফিরে আসছে।

পর্যটকদের ব্যয়ও গত বছরের স্তরের প্রায় ৭০ শতাংশ ফিরে এসেছে।
ছবি: রয়টার্স
অর্থনীতিবিদেরা এই বছরের শুরুর দিকে মনে করছিলেন যে চীনের পুনরুদ্ধার ভারসাম্যহীন হবে, ভোক্তা ব্যয় সেভাবে ফিরে আসবে না। তবে বাণিজ্য উত্তেজনা সত্ত্বেও চীনের অর্থনীতি বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে, যা চীন যে আবার তার গতিতে ফিরছে সেই নির্দেশই দিচ্ছে।

আরও ভারসাম্যপূর্ণ পুনরুদ্ধার হচ্ছে

অবশ্য এই গোল্ডেন উইকের আগে থেকেই চীনের অর্থনীতি ফিরতে শুরু করে। শিল্প খাতের কার্যক্রম গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছায় সেপ্টেম্বরে। নানা জরিপে দেখা গেছে ছোট ব্যবসায়ীদের অবস্থাও ফিরছে। সেবা খাতও ভালো করছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ভোক্তা ব্যয়ও, যা বেশ আশাব্যঞ্জক। অর্থনীতিবিদেরা এই বছরের শুরুর দিকে মনে করছিলেন যে চীনের পুনরুদ্ধার ভারসাম্যহীন হবে, ভোক্তা ব্যয় সেভাবে ফিরে আসবে না। তবে বাণিজ্য উত্তেজনা সত্ত্বেও চীনের অর্থনীতি বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে, যা চীন যে আবার তার গতিতে ফিরছে সেই নির্দেশই দিচ্ছে।

করোনার কারণে দেশে দেশে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ রাখা হয় সীমানা।
ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনের সঙ্গে এই বিরোধ অব্যাহত রাখে, তবে চীনের প্রবৃদ্ধি ২০৪০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর আধা শতাংশ করে কমবে, যা অবশ্যই দেশটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

চ্যালেঞ্জ এখনো আছে

শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের সব ইঙ্গিত থাকলেও চ্যালেঞ্জও আছে। ফিচ রেটিং বিশ্লেষকেরা বলছেন, অন্যান্য দেশের মতো এই মহামারিটি চীনের দরিদ্র ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ওপর মারাত্মক ক্ষতি করেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ অভিবাসী শ্রমিকদের গড় মাসিক আয় এক বছরের আগের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই শ্রমিকদের বেশির ভাগই নির্মাণ, উৎপাদন এবং অন্যান্য স্বল্প বেতনের কাজে যুক্ত। অথচ অর্থনীতিতে একটি বড় ভূমিকা রাখেন তাঁরা। চীনের স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো, যারা বছরে ৭ হাজার ৩৫০ ডলারের কম আয় করে, তারা যেকোনো আয় গোষ্ঠীর চেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। ফিচ রেটিং বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ থেকে বোঝা যায় যে সাম্প্রতিক ভোগব্যয় পুনরুদ্ধার সম্ভবত কিছুটা উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীর দিক থেকে আসছে। এ ছাড়া অনেকে মনে করছেন, বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বাড়লেও মার্কিন-চীন উত্তেজনা নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনের সঙ্গে এই বিরোধ অব্যাহত রাখে, তবে চীনের প্রবৃদ্ধি ২০৪০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর আধা শতাংশ করে কমবে, যা অবশ্যই দেশটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।