আমদানি সন্তোষজনক, তবু কেন সংকট

গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—দুই মাসে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয় প্রায় ৯৩ হাজার টন।

নিম্ন আয়ের মানুষের বাজার ব্যয়ের বড় অংশই যায় চাল, ডাল ও তেলের পেছনে। এক ক্রেতা ২০ টাকার তেল নিয়ে ফিরছেন। তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায়
ছবি: সাজিদ হোসেন

বিশ্বে সয়াবিন তেলের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ বাংলাদেশ। তবে ব্যবহারের দিক থেকে দেশের অবস্থান দশম। বিশ্ববাজারে তেলের দামের অস্থিরতার পর বাজারে এখন সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছে।

আমদানির তথ্য বলছে, বাজারে এখনই সয়াবিন তেলের সংকট হওয়ার কথা নয়। তারপরও বিশ্ববাজারে দাম বাড়তে থাকায় সয়াবিন কেনায় ক্রেতাদের হুড়োহুড়ি বেড়েছে বাজারে। সেই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন বিক্রেতাদের কেউ কেউ। বেশি দাম পেতে মজুত করছেন তাঁরা। আবার সয়াবিন পরিশোধনকারী কোম্পানির পরিবেশকেরাও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ দিচ্ছে না দোকানে। এতে সয়াবিনের সংকট দেখা দিয়েছে।

দেশে সয়াবিনের চাহিদা মেটানো হয় দুইভাবে—ছয়টি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত সয়াবিন আমদানি করে পরিশোধনের পর বাজারজাত করে; আর সয়াবীজ আমদানি করে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সয়াবিন তেল বাজারজাত করে। এ দুইভাবে দেশের বার্ষিক ১২-১৩ লাখ টন সয়াবিনের চাহিদা পূরণ করা হয়। সেই হিসাবে প্রতি মাসে সয়াবিনের চাহিদা রয়েছে এক লাখ টনের কাছাকাছি। তবে রোজায় এই চাহিদা কিছুটা বেড়ে যায়।

২০২০-২১ অর্থবছরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয় ৭ লাখ ৮৫ হাজার টন। আর প্রায় ২৪ লাখ টন সয়াবিন বীজ থেকে পাওয়া যায় ৪ লাখ ৩৩ হাজার টন তেল। অপচয় বাদ দিলে কমবেশি ১২ লাখ টন সয়াবিন আমদানি হয়েছে।

আমদানির তথ্যে দেখা যায়, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাসে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করা হয় প্রায় ৯৩ হাজার টন। বন্ড সুবিধার আওতায় আমদানির পর ওই তেল রাখা হয় চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সাতটি ট্যাংক টার্মিনালে। মূল্য সংযোজন কর পরিশোধ করে ট্যাংক থেকে খালাস করে ওই তেল কারখানায় নেওয়া হয়। কারখানায় পরিশোধনের পর বোতলজাত বা খোলা দুইভাবে বিক্রি করে কোম্পানিগুলো।

সয়াবিনের করভার কমানো হলেও ভোক্তাদের সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং সরকার যদি বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আমদানি করে বাজারে সরবরাহ করে, তাহলে সুফল মিলবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল বাজারজাত হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার টন। ট্যাংক টার্মিনালে আগের মজুত থাকায় আমদানির চেয়ে বেশি পরিমাণ তেল বাজারজাতের জন্য খালাস করতে পেরেছে কোম্পানিগুলো। সাধারণত ট্যাংক টার্মিনাল থেকে খালাসের পর পরিশোধন করে বাজারজাত করতে এক-দুই সপ্তাহ সময় লাগে। সেই হিসাবে সয়াবিন তেলের একাংশ কোম্পানির কারখানা বা দোকানে বাজারজাতের অপেক্ষায় রয়েছে।

গত বছর রোজার আগে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বাজারজাত হয়েছিল ১ লাখ ২১ হাজার টন সয়াবিন তেল। এ বছর একই সময়ে গতবারের চেয়ে ৪৮ হাজার টন বেশি তেল আমদানি হয়েছে। আবার গত বছরের চেয়ে এবার জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সয়াবিন বীজ আমদানি বেশি হয়েছে ৪০ হাজার টন। তাতে বীজ থেকে সয়াবিন উৎপাদনও আগের তুলনায় বেড়েছে। এ দুটি তথ্য প্রমাণ করে, বাজারে সংকট হওয়ার কথা নয়।

সয়াবিনের আমদানি অব্যাহত রেখেছি আমরা। তবে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে এখানেও মূল্য যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে চাহিদানুযায়ী আমদানি অব্যাহত থাকবে।
মোহাম্মদ মোস্তফা, পরিচালক, টিকে গ্রুপ

আমদানি থেকে বাজারজাত পর্যন্ত সয়াবিন তেল পরিশোধনসহ নানা কারণে ৩ থেকে ৪ শতাংশ সিস্টেম লস বা অপচয় হয়। দেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান সয়াবিন তেল আমদানি করে। এই ছয়টি প্রতিষ্ঠান হলো সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল। আর সয়াবিন বীজ মাড়াই করে সয়াবিন উৎপাদন করে প্রধানত দুটি প্রতিষ্ঠান-সিটি ও মেঘনা গ্রুপ।

আমদানি না বাড়ালে সামনে সংকট

কাস্টমসের ৭ মার্চের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই দিন চট্টগ্রামের ৭টি ট্যাংক টার্মিনালে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের মজুত ছিল ১৪ হাজার টন। বন্দরে দুটি জাহাজে করে আনা হয়েছে ৩২ হাজার টন সয়াবিন তেল। সব মিলিয়ে পরিশোধন হয়নি এমন সয়াবিন তেল আছে ৪৬ হাজার টন। রোজার আগে এই ৪৬ হাজার টন সয়াবিন তেল পরিশোধন করে বাজারজাতের সুযোগ রয়েছে। ঋণপত্রের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ২৩ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। সাধারণত সয়াবিনের ঋণপত্রের পর পণ্য দেশে পৌঁছাতে কমবেশি ৪৫ দিন লাগে।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের পর বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম ঊর্ধ্বমুখী। যুক্তরাষ্ট্রে ভোগ্যপণ্য বেচাকেনার এক্সচেঞ্জ ‘শিকাগো বোর্ড অব ট্রেড’–এ গত ৯ দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ টাকা। এ পরিস্থিতিতে আমদানিকারকেরা আমদানি করছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। কারণ, সয়াবিনের আমদানি দেশের বাজারে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের হাতে। এসব প্রতিষ্ঠান আমদানি অব্যাহত না রাখলে সামনে সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা আছে।

তবে টিকে গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তফা হায়দার বলেন, ‘সয়াবিনের আমদানি অব্যাহত রেখেছি আমরা। তবে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে এখানেও দাম যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে চাহিদানুযায়ী আমদানি অব্যাহত থাকবে।’

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর বিশ্ববাজারে এমনিতেই সয়াবিনের দাম বাড়তি ছিল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ গত ৯ ফেব্রুয়ারি এক প্রতিবেদনে বলেছে, খরার কারণে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়েতে এবার তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন সয়াবিন বীজ উৎপাদন হবে। তাতে চলতি উৎপাদন মৌসুমে সয়াবিনের উৎপাদন পূর্বাভাসের তুলনায় ১ কোটি ৯০ লাখ টন কমে যেতে পারে। এখন বিশ্ববাজারে নতুন সংকট তৈরি করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ দুটি দেশ থেকে সূর্যমুখী তেল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাপ বেড়েছে সয়াবিন ও পাম তেলের ওপর।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সয়াবিনের করভার কমানো হলেও ভোক্তাদের সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং সরকার যদি বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আমদানি করে বাজারে সরবরাহ করে, তাহলে সুফল মিলবে। চাহিদানুযায়ী আমদানি হচ্ছে কি না, তাও তদারকি করা দরকার।

এদিকে সরকার ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় করতে সয়াবিনের উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, কারণ এতে তাঁদের ব্যয় আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সংশ্লিষ্ট মানুষেরা বলছেন, সরকার আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট আরও আগে প্রত্যাহার করলে কিছুটা সুফল মিলত।