আলিবাবা আসলে করেছে কী?

রেকর্ড জরিমানার মুখে পড়েছে বিশ্বের অন্যতম বড় অনলাইন বেচাকেনার প্রতিষ্ঠান আলিবাবা। চীনা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আলিবাবার ওপর ২৮০ কোটি ডলারের জরিমানা চাপিয়েছে। হিসাবমতো ২০১৯ সালে আলিবাবা যা আয় করেছে, তার ৪ শতাংশ এই জরিমানা। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।

বেশ কিছুদিন ধরেই চীনা সরকারের খড়্গের মুখে আলিবাবা। আসলে আলিবাবার ওপর অভিযোগটা কী? চীনের নিয়ন্ত্রকেরা বলেছেন, ইন্টারনেট জায়ান্ট বেশ কয়েক বছর ধরে তার প্রভাবশালী বাজার অবস্থানকে অপব্যবহার করেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, চীন ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে যেতে চায়, যা একচেটিয়াভাবে বেড়ে উঠেছে। আলিবাবাকে বলা হয় চীনের আমাজন। চীনের ভেতরে এটি জায়ান্ট কোম্পানি। খুচরা বিক্রয় এর মূল কার্যক্রম হলেও এটি ডিজিটাল পেমেন্ট নিয়ে, ক্রেডিট ও ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলতে চাইছে, অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম থামিয়ে আলিবাবা প্রতিযোগিতা সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছে।

আসলে গত বছর থেকেই আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মার বিরুদ্ধে কাজ করছে চীনা সরকার। অথচ জ্যা মা আর সাফল্য যেন এখন সমার্থক শব্দ। কিন্তু কেন? এ নিয়ে গত বছর নিউইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

জ্যাক মা

ইংরেজির শিক্ষক জ্যাক মা একসময় উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। দখল করে নেন চীনের শীর্ষ ধনীর স্থান। তিনি আলিবাবা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০১৬ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কজন প্রভাবশালী চীনা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেখা করেন, তার মধ্যে জ্যাক মা একজন। অনলাইনে অনেকেই জ্যাক মাকে ‘ড্যাডি মা’ বলতেন। ২০১৭ সালে শীর্ষস্থানীয় চীনা তারকাদের সঙ্গে একটি শর্টফিল্মে অপরাজেয় কুংফু মাস্টারের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। চীনা পপ গায়িকা ফায়ি ওংয়ের সঙ্গে গানও গান তিনি। চীনের শীর্ষস্থানীয় চিত্রশিল্পী জেং ফাংঝির সঙ্গে তাঁর আঁকা ছবি সোথবাই নিলামে ৫৪ লাখ ডলারে বিক্রি হয়। চীনের তরুণ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের মুখে মুখে কেবল ‘ড্যাডি মা’র গল্প।

তবে হঠাৎ করেই যেন মানুষের হৃদয়ের নায়ক জ্যাক মা খলনায়কে পরিণত হন। কেউ কেউ তাঁকে ডাকতে থাকে ‘দুষ্ট পুঁজিবাদী’, ‘রক্তখেকো ভূত’ নামে। একসময়ের ভরসার ‘ড্যাডি মা’ হয়ে যান ‘ছেলে’, না হয় ‘নাতি’। এমনকি লেখকেরা ‘জ্যাক মার ১০টি পাপেরও’ তালিকা করেন। আসলে এই খ্যাতি কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো জ্যা মা চীনা সরকারের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়তে শুরু করেছিলেন। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের তদন্তও শুরু করে সরকার। এ ছাড়া অ্যান্ট গ্রুপ থেকে এই প্রতিষ্ঠানের অনলাইন আর্থিক সেবা দেওয়া বিভাগকে আলাদা করে ফেলারও নির্দেশ দিয়েছে তারা।

চীনের অসংখ্য মানুষ মনে করা শুরু করে, জ্যাক মা'র মতো এত সুযোগ-সুবিধা তারা পাচ্ছেন না। এক বছর করোনা মহামারির মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন তারা। চীনের জনগণ মনে করেন এ সময়েও জ্যাক মার মতো ধনীরা বেশি সুবিধা পেয়েছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন তালিকায় দেখা গেছে চীনের কোটিপতির সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের চেয়েও বেশ। অন্যদিকে আবার দেশটির প্রায় ৬০ কোটি মানুষের মাসিক আয় ১৫০ ডলার বা তারও কম। গত বছর চীনের সামগ্রিক ব্যয় ৫ শতাংশ কমেছে, অথচ বিলাসদ্রব্যের পেছনে গত বছরের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

নিউইয়র্ক টাইমসের ওই বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা তরুণ শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী চাকরি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়। কারণ উন্নত শহরগুলোতে থাকার ব্যবস্থা করাই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দেখা যায়, অ্যান্ট গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নেওয়া তরুণ জনগোষ্ঠী পরে ঋণ নেওয়ার জন্যই অনুতাপে ভোগেন। তাই বলা যায়, চীনের অর্থনৈতিক সফলতা আসলেও ধনীদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশও প্রকট হয়ে উঠছে চীনে।

চীনের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা আসলে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। এখন ঘটনা হচ্ছে, এই পুঁজিতন্ত্রের ভেতর বড় আয়তনে একচেটিয়া ব্যবসা তৈরি হতে দিতে অনিচ্ছুক সরকার। আলিবাবা এবং আরও একটি প্রতিষ্ঠান মিলে চীনের ই-কমার্সের প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে ইতিমধ্যে। এ রকম ঘটতে থাকলে অন্য ছোট ছোট সংস্থার বিকাশ কঠিন হয়ে পড়তে বাধ্য। সরকার এ অবস্থা বদলাতে চাইছে। জ্যাক মা এখানে উপলক্ষ, লক্ষ্য হলো, একচেটিয়া পুঁজিবাদ ঠেকানো। কারণ, জ্যাক মার বিরুদ্ধে এতটা পদক্ষেপে শঙ্কিত আছেন দেশের অন্য টেক জায়ান্টরাও। নিয়ন্ত্রকদের দ্বারা ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে রয়েছেন তাঁরাও। একচেটিয়া বিরোধী বিধি লঙ্ঘনের কারণে গত মাসে ১২ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছিল। সংস্থাগুলোর মধ্যে আছে টেনসেন্ট, বাইদু, দিদি চুচিং, সফটব্যাংক এবং একটি বাইটড্যান্স।