ইউরোপে কেন বাংলাদেশ অনুপস্থিত


ভাষা, শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, সংস্কৃতির এত প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও ইউরোপে কেন চোখে পড়ার মতো বাংলাদেশের কোনো অস্তিত্ব নেই? কখনো কি এই দুই প্রান্তের চাহিদার সমন্বয় করার চিন্তা বা চেষ্টা হয়েছিল? ইউরোপ বাংলাদেশে কী চাইতে পারে? কিংবা বাংলাদেশের কী চাহিদা থাকতে পারে তাদের কাছে? বাণিজ্য? টাকা? ধরা যাক, তাই। কিন্তু সেটার প্রক্রিয়া কী ধরনের হওয়া উচিত?

যেকোনো ধরনের উন্নতির জন্যই দরকার উন্নত কাঠামো। আর সে জন্য চাই উন্নত প্রযুক্তি। প্রযুক্তির ওপর একবিংশ শতাব্দী দাঁড়িয়ে আছে, নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আমদানি করা দরকার।

নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ীরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন, তাঁরা তাঁদের জ্ঞান, চিন্তা, প্রযুক্তি নিয়ে বাংলাদেশে আসতে ইচ্ছুক ও প্রস্তুত। কিন্তু তাঁরা আস্থাভাজন অংশীদার খুঁজে পান না। তাঁদের এত আগ্রহের কারণ কী? কারণ, ভৌগোলিক দিক থেকে বিনিয়োগের জন্য এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। আর সেটাই তাঁদের লক্ষ্য। প্রতিটি দেশের বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্য থাকে, আর তারা লাভজনক বিনিয়োগে আগ্রহী। এত গেল নেদারল্যান্ডসের দিক। নেদারল্যান্ডস মানেই বুঝি আমরা পোল্ডার, ডাইক আর আলু। তাহলে বাংলাদেশ কেন নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হবে?

আমরা কি জানি আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগের সমান হলেও নেদারল্যান্ডস এই বিশ্বের ষোলোতম অর্থনীতি। নেদারল্যান্ডসের মতো একটি ছোট্ট দেশে ৮৫ রকমের টমেটো উৎপন্ন হয়, ৫৫৫ রকমের আলু উৎপন্ন হয়। দুই হাজারের ওপর ভিন্ন রকমের হিয়াসিন্ট ফুলের চাষ হয়। পেঁয়াজের জন্য কয়েক দিন পরপর আমাদের ভারতের মুখাপেক্ষী হতে হয়, কিন্তু নেদারল্যান্ডস পেঁয়াজ রপ্তানি করে। কদিন আগে বাংলাদেশও নেদারল্যান্ডস থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছে। পেঁয়াজ আমদানি না করে পেঁয়াজ ফলানোর প্রযুক্তি আর উন্নত প্রজাতির পেঁয়াজ বীজ আমদানি করলে কেমন হয়?

আজকের যুগের চাহিদা তো টাকায় বা পণ্যে আটকে থাকতে পারে না, সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো প্রযুক্তির। ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের অসাধারণ সাদৃশ্য রয়েছে, বাংলাদেশের ডেলটা প্রজেক্ট নেদারল্যান্ডস তদারকি করছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস প্রায় সমপরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসে কাজ করছেন বাংলাদেশ থেকে আসা প্রযুক্তিবিদেরাও। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে কাজ করার জন্য এর চেয়ে বেশি কারণ কি বাংলাদেশের প্রয়োজন আছে?

প্রযুক্তি আমদানি ও বিনিয়োগ সমন্বয়ের লক্ষ্যে নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের নিয়ে, দ্য হেগে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো ডিসেম্বরের ৮ আর ৯ তারিখে ভার্চ্যুয়ালি হয়ে গেল, ‘বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস ইনভেস্ট সামিট টোয়েন্টি টোয়েন্টি।’এতে অংশ নেয় ডাচ বিনিয়োগ সংস্থা আরভিও। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করে বিজিএমইএ, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, সিসিসিআই, স্কয়ার বাংলাদেশ, আকিজ গ্রুপ, প্রাণ আরএফএল গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, কাজী গ্রুপ, পিএইচপি, বিডা, বেজা, বেপজাসহ আরও অনেকে।

বাংলাদেশের চাহিদা ছিল কৃষি, হালকা প্রকৌশল আর সমুদ্র সম্পদের ব্যবহারে নেদারল্যান্ডসের সাহায্য। সে অনুযায়ী সম্মেলনটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। ভার্চ্যুয়াল এই সম্মেলনের কৃষি পর্বে ২৩১ জন উপস্থিত ছিলেন, হালকা প্রকৌশল পর্বে ১০০ জনের কিছু বেশি আর পানিসম্পদ বিষয়ে অংশ নেন ১৩০ জন।

সম্মেলন চলাকালীন মন্তব্য বিভাগ ছিল বাংলাদেশিদের উচ্ছ্বসিত মন্তব্যে ভরপুর, যা ডাচ ব্যবসায়ীদের উৎফুল্ল করেছে। বাংলাদেশের ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এসব ডিজেলচালিত নৌকায় খরচ বেশি আর নদী ও পরিবেশের যে দূষণ হচ্ছে, তা নিয়েও বিশদ আলোচনা হলো। ডাচ বিশেষজ্ঞরা নৌকার আকৃতি ও ডিজাইনে পরিবর্তন আনাসহ ডিজেল থেকে এলপিজিতে রূপান্তরের পরামর্শ দিলেন।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নদীব্যবস্থায় সড়ক ও দ্রুততম বেগে চলা রেলপথ সংযোজনের পরিকল্পনা ডাচ ব্যবসায়ীদের জন্য দক্ষ ও আকর্ষণীয় প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসার সুযোগ হতে পারে বলে আলোচনা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, নদী খননের হন্য বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যত ড্রেজার আছে, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি ড্রেজার প্রয়োজন। শহরজুড়ে মানসম্পন্ন পরিশোধিত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, শিল্পাঞ্চলের বর্জ্য পানিকে পরিশোধিত করে পুনরায় ব্যবহার, শতাধিক প্রজাতির দেশীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মাছের জিন অন্বেষণ, এমনকি ওমেগা থ্রিতে ভরপুর ইলিশ কি স্যামনের জায়গা নিতে পারে কি না ইত্যাদি আরও বহু সম্ভাবনার কথাও আলোচনা হয়।

ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ হলো পরবর্তী এশিয়ান বাঘ, বাংলা বাঘ। বাংলাদেশের এখন শুধু ভালো প্রচার দরকার।
হ্যারি ফেরওয়াই, বাংলাদেশে নিযুক্ত ডাচ রাষ্ট্রদূত

বাংলাদেশে নিযুক্ত ডাচ রাষ্ট্রদূত হ্যারি ফেরওয়াই এক ভিডিও বার্তায় এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘৫০ বছর ধরে নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশের পাশে আছে, বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে যেমন বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নত করতে চায়, ঠিক তেমনি নেদারল্যান্ডসও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতি চায়। ডেনহাগে অপেক্ষা করে আছে বাংলাদেশ দূতাবাস আর ঢাকায় অপেক্ষা করে আছি আমি, যেকোনো প্রয়োজন, প্রশ্ন, তথ্যের জন্য সরাসরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ হলো পরবর্তী এশিয়ান বাঘ, বাংলা বাঘ। বাংলাদেশের এখন শুধু ভালো প্রচার দরকার। এই সম্মেলনের বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী ডাচ, তাই যখন কোভিড–১৯ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর আবার ভ্রমণের সুযোগ হবে, তাদের সবাইকে ২০২১–এ আমি ঢাকায় আমন্ত্রণ জানাতে চাই।’

অনেকেই হয়তো বলতে পারেন এই সম্মেলন থেকে নগদ কী পাওয়া গেল। না, নগদ নগদ কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়নি। দুই প্রান্তের সেতুবন্ধই ছিল সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্যে। এখন থেকে প্রতিবছর এই সম্মেলন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে এই পরিকল্পনা ওয়ান টু ওয়ান বিজনেস, বিজনেস টু বিজনেসে নিয়ে যাওয়াও পরিকল্পনার অংশ। বড় লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অনেক বড় প্রস্তুতির দরকার হয়। এই সম্মেলন তার সূচনা করেছে। আশা করা হচ্ছে, শিগগিরই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যাবে।