এপ্রিল-জুনে ভারতের প্রবৃদ্ধি ২০.১ %

ছবি: রয়টার্স

গত বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) লকডাউনের ধাক্কায় কার্যত অচল হয়ে গিয়েছিল ভারতীয় অর্থনীতি। অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল ২৪ শতাংশেরও বেশি। তবে বছর ঘুরতেই সেই ক্ষত অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে দেশটি। তবে প্রাক কোভিড সময়ে ফিরতে আরও সময় লাগবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

সাধারণত চলতি অর্থ বছরের ত্রৈমাসিকভিত্তিক প্রবৃদ্ধি হিসাব করা হয় গত বছরের একই সময়ের সাপেক্ষে। সেই হিসাবে এ বছর এপ্রিল-জুনে প্রবৃদ্ধির হার 'তাক লাগানো' ২০ দশমিক ১ শতাংশ।

ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারও বলছে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনো কোভিডের আগের বছরের (২০১৯-২০) জায়গায় ফিরতে পারেনি দেশটির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি (বিস্তারিত সঙ্গের সারণিতে)। তবে গতকাল মঙ্গলবার প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান সামনে আসতেই তা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বের সাফল্য বলে তুলে ধরে প্রচারে নেমে পড়েছে ভারতের বিজেপি সরকার। ঘোষণা, 'ইন্ডিয়া বাউন্সেস ব্যাক'! অর্থাৎ, ভারত ঘুরে দাঁড়াল।

তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, এতে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, গত অর্থ বছরের এপ্রিল-জুনে লকডাউনের ধাক্কায় জিডিপি ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। সে তুলনায় এ বছরের এপ্রিল-জুনে জিডিপি ২০ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ এখনো তা কোভিডের আগের বছরের (২০১৯-২০ সালের এপ্রিল-জুন) স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। সে বছরও কিন্তু অর্থনীতির গতি শ্লথ ছিল। সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের বক্তব্য, 'উৎসব করার আগে মনে রাখা দরকার, এখনো আমরা কোভিডের আগের জায়গায় ফিরিনি। এখনো কিছুটা দূরত্ব আছে।'

সরকারি পরিসংখ্যানও বলছে, কোভিডের আগের বছরে এপ্রিল-জুনে জিডিপি ছিল ৩৫ দশমিক ৩৫ লাখ কোটি রুপি। লকডাউনের ধাক্কায় ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে তা ২৬ দশমিক ৯৫ লাখ কোটি রুপিতে নেমে যায়। এ বছরের এপ্রিল-জুনে তা বেড়ে ৩২ দশমিক ৩৮ লাখ কোটিতে উঠলেও এখনো কোভিডের আগের বছরের তুলনায় তা প্রায় ৩ লাখ কোটি রুপি কম।

সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলা যায়, কোভিডের আগে জিডিপি ১০০ রুপি হলে লকডাউনের সময়ে তা কমে ৭৫ দশমিক ৬ রুপি হয়েছিল। এখন আবার তা বৃদ্ধি পেয়ে ৯০ দশমিক ৭ রুপি হলো। কিন্তু এখনো তা ১০০ রুপিতে পৌঁছাতে পারেনি।

তাতে অবশ্য সরকারি মহল ও বিজেপির তরফ থেকে প্রচারের ঢাক-ঢোল পেটানো বন্ধ হয়নি। ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আঁচ করে আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়া ছিল। এ বার প্রবৃদ্ধির হার সামনে আসতেই সরকারের ‘মাই-গভ-ইন্ডিয়া’ মঞ্চ থেকে ঘোষণা, ‘ইন্ডিয়া বাউন্সেস ব্যাক’। বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালবীয় টুইট করে একে ‘ম্যাসিভ’ আখ্যা দিয়ে জানান, ভারত প্রবৃদ্ধির হারে রেকর্ড করল। বিজেপি নেতারা এ জন্য নরেন্দ্র মোদির আর্থিক নীতিকেই কৃতিত্ব দিয়েছেন।

মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কৃষ্ণমূর্তি সুব্রামানিয়াম বলেন, ভারতীয় অর্থনীতির ভিত যথেষ্ট মজবুত। সরকারের অবকাঠামোয় বিপুল খরচ ও কাঠামোগত সংস্কারের দৌলতে ভারত আগামী দিনে আরও মজবুত আর্থিক প্রগতির দিকে এগোবে। তাঁর যুক্তি, গত বছরই তিনি বলেছিলেন, যে গতিতে অর্থনীতি তলানিতে নেমেছে, সেই গতিতেই আবার উঠে আসবে। কারণ, লকডাউনে আর্থিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় জিডিপি ধাক্কা খেয়েছিল। অর্থনীতির অন্তর্নিহিত সমস্যা ছিল না। তাঁর দাবি, আগামী বছরের মধ্যেই জিডিপি প্রাক কোভিড স্তরে ফিরে যাবে। নীতি আয়োগের উপাধ্যক্ষ রাজীব কুমার ও সিইও অমিতাভ কান্তেরও ভবিষ্যদ্বাণী, আগামী দিনে প্রবৃদ্ধির হারে আরও গতি আসবে। আবার ভারতীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের দাবি, স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নতি অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে আস্থা সৃষ্টি করবে।

অর্থনীতিবিদেরা সকলে অবশ্য এত খানি আশাবাদী নন। ভারতের সাবেক মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেনের মতে, সরকার অবকাঠামোয় বিপুল খরচের কথা বললেও খাতায়-কলমে তা দেখা যাচ্ছে না। মঙ্গলবার সরকারি আয়-ব্যয়ের যে হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী, এপ্রিল-জুনে রাজস্ব ঘাটতি কোভিডের আগের বছরগুলোর তুলনায় বরং অনেক কম। সরকারি আয় বেড়েছে। কিন্তু খরচ সেই তুলনায় খুবই কম হয়েছে। জিডিপির তুলনায় অবকাঠামোয় সরকারি খরচ, সরকারি বিনিয়োগ গত বছরের তুলনায় সামান্য বেড়েছে, কিন্তু সরকারি ক্রয়ে খরচ কমেছে।

পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, একমাত্র কৃষি বাদে বাকি সব ক্ষেত্রে কোভিডের আগের বছরের তুলনায় এ বছরের এপ্রিল-জুনের প্রবৃদ্ধি কম। কল-কারখানা বা উৎপাদন শিল্প, হোটেল, পরিবহন, আবাসন-সবখানেই গত বছরের লকডাউনের সময়ের তুলনায় পরিস্থিতি অনেক ভালো। কিন্তু কোভিডের আগের বছরের তুলনায় তা এখনো আশাব্যঞ্জক নয়। একই ভাবে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, কোভিডের আগের স্তরে যেতে এখনো কিছুটা পথ বাকি। বাজারে কেনাকাটা বা বেসরকারি খরচও লকডাউনের সময়ের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু লকডাউনের সময় তা ২৬ শতাংশ কমেছিল। সব মিলিয়ে, ওই খরচের মাত্রা এখনো কোভিডের আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ কম।

সরকারের যুক্তি, এ বার এপ্রিল-মে মাসে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ ধাক্কা দিয়েছিল। ফলে গত বছরের মতো এবারও এ সময়ে অনেক জায়গায় লকডাউন ছিল। বিরোধী রাজনীতিকেরা সে কথাই বলছে, দ্বিতীয় ঢেউ ধাক্কা দিলেও দেশ জুড়ে লকডাউন হয়নি। প্রায় সবই চালু ছিল। তা সত্ত্বেও অর্থনীতিকে কোভিডের আগের জায়গায় নিয়ে যেতে না পারাকে মোদি সরকারের ব্যর্থতা বলে দাবি করছেন তাঁরা।