এলডিসি সুবিধা বাড়ানো নিয়ে সব দেশ একমত হতে পারছে না

ডব্লিউটিওর ১২তম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের প্রথম দিন বক্তব্য দেন সংস্থার মহাসচিব এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা

শেষ পর্যন্ত এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে যাওয়া দেশগুলোকে নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দ্বাদশ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্যের কারণে বৈঠক এক দিন বাড়ানো হয়েছে।

যেসব দেশের এলডিসি উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে, তারা দাবি করেছিল, উত্তরণ টেকসই করতে তাদের এলডিসি সুবিধা আরও তিন বছর বৃদ্ধি করা হোক। বিশেষ করে, তারা অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা সম্প্রসারণের দাবি করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা সব দেশকে ঢালাওভাবে এই সুবিধা দিতে নারাজ। কোন দেশের কী সুবিধা প্রয়োজন, সে বিষয়ে তারা যেন দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আসে। তখন বিবেচনা করা হবে, তারা কাকে কী সুবিধা দেবে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ সব বড় দেশ এলডিসি উত্তরণের দেশগুলোকে আরও কিছুদিন এলডিসি সুবিধা দিতে নীতিগতভাবে একমত। বৈঠকের শেষ দিনে সম্ভবত তাদের মধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য হবে। তবে সেটা মন্দের ভালো বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা—অন্তত কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ার চেয়ে ভালো।

ডব্লিউটিওর বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে অংশ নিয়েছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, অন্তত একটা ঐকমত্য হোক। সেটা অন্তত পরবর্তীকালে আলোচনার সূচনাবিন্দু হিসেবে কাজ করবে। তবে কত দিন এই সুবিধা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্য হলে ভালো হতো, তখন আর দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে আলোচনার প্রয়োজন হতো না।’

তবে কোনো দেশ চাইলে কাউকে সুবিধা দিতে পারবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘হ্যাঁ, সেটা সম্ভব, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে বলেছে, তারা তিন বছর এসব সুবিধা অব্যাহত রাখবে। এখন জাপান যদি মনে করে, তারাও সুবিধা দেবে, তাহলেও সমস্যা নেই। তবে ডব্লিউটিওতে এ বিষয়ে ঐকমত্য হলে ভালো হতো।’

ডব্লিউটিওতে এলডিসি গ্রুপের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছে আফ্রিকার দেশ চাদ। তবে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে বলে জানা গেছে। মন্ত্রী পর্যায়ের চূড়ান্ত বৈঠকে এলডিসি-উত্তরণ ঘটাতে যাওয়া দেশগুলো সম্পর্কে যেন কিছু বলা হয়, বাংলাদেশ প্রাণপণে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।

তবে ডব্লিউটিওর এবারের বৈঠক অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোভিডের ধাক্কার পর বিশ্ব অর্থনীতি যখনই কেবল ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, তখন শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতির সূচক মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির গতি আবার কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে এবারের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অনেক বিষয়েই উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতানৈক্য হয়েছে বলে জানা যায়। যেমন ট্রিপস চুক্তি, মৎস্য খাতে ভর্তুকি, সরকারের মজুত, ই-কমার্স, আমদানি শুল্কে ছাড়—এসব বিষয়ে মতৈক্য হচ্ছে না। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর এসব বিষয়ে বাংলাদেশেরও বক্তব্য থাকবে ঠিক; কিন্তু এখন বাংলাদেশের অগ্রাধিকার হচ্ছে, এলডিসি উত্তরণের পর আরও কয়েক বছর বাণিজ্য–সুবিধা বজায় রাখা।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে বাংলাদেশসহ উত্তরণের তালিকায় থাকা দেশগুলো এবার বৈঠক থেকে বেশি কিছু আশা করছে না। এখন একটিই প্রত্যাশা, তা হলো মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পর ডব্লিউটিওর ঘোষণায় যেন সুবিধার মেয়াদ সম্প্রসারণের ঘোষণা থাকে। এতে পরবর্তী সময়ে তার রূপরেখা নির্ধারণ করা যাবে, তা না হলে বিষয়টি নির্ভর করবে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ওপর।

পাঁচ বছর পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এই মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে সময়টা ভালো নয়। সংস্থার মহাসচিব এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা বৈঠকের উদ্বোধনী অধিবেশনে বলেন, ‘আমার জীবদ্দশায় একসঙ্গে এত দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখিনি। তবে আমাদের অনেক সম্ভাবনা আছে—সব সম্ভাবনাই আলোর মুখ দেখবে, তা নয়, দুয়েকটি সম্ভাবনা আলোর মুখ দেখলেই ধরে নিতে হবে, আমরা সফল।’

ডব্লিউটিওর মহাসচিবের উদ্বেগ শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছে। বিষয়টি হলো খাদ্যনিরাপত্তা, গভীর সমুদ্রে অবাধে মৎস্য শিকারে ভর্তুকি বন্ধের দাবির পক্ষে এখনো পুরোপুরি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলো। ফলে ১২তম বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মন্ত্রী পর্যায়ের এই সম্মেলন (এমসি ১২) এক দিন বাড়ানো হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার বৈঠক শেষ হবে।