জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় ধনী দেশগুলোতে মূলস্ফীতি বাড়ছে

ছবি: রয়টার্স

জি-২০ভুক্ত দেশগুলোতে আগামী দুই বছর মহামারির আগের সময়ের চেয়ে বেশি হারে মূল্যস্ফীতি থাকবে। পণ্যের উচ্চমূল্য ও জাহাজের ভাড়া বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকে থাকবে বলে জানিয়েছে প্যারিসভিত্তিক ধনী দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি।

ওইসিডি জানিয়েছে, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়াতে পারে ৩ শতাংশ, যা উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এর বিপরীতে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানিতে মূল্যস্ফীতি কমবে বলে আশা করছে তারা।

বিশ্বব্যাপী কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। অর্থনীতি স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে, মানুষও ব্যয় করতে আগ্রহী, কিন্তু পণ্য পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে পণ্যের স্বল্পতা আছে। আবার বিধিনিষেধের পর কিছু পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে।

ওইসিডি বলছে, সরবরাহের ঘাটতি বেশি দিন ধরে চললে মূল্যস্ফীতির হারও দীর্ঘ সময় বাড়তি থাকবে। তাদের ধারণা, ২০২১ সালের শুরুতে জি-২০ভুক্ত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার ৪ দশমিক ৫ এবং ২০২২ সালের শেষ নাগাদ ৩ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। তবে এই পূর্বাভাস নিয়েও যথেষ্ট অনিশ্চয়তা আছে বলে জানিয়েছে ওইসিডি।

ওইসিডি জানিয়েছে, টিকাদানে গতি এসেছে, মানুষের সঞ্চয়ও ফুরিয়ে যাচ্ছে, ফলে মানুষ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়বে। আবার ভাইরাসের নতুন কোনো ধরন আসবে না, এমন কথাও বলা যায় না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখনো ভাইরাসের ক্রমবর্ধমান প্রকোপের সঙ্গে লড়াই করছে। ফলে ভাইরাস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত ঠিক বলা যাচ্ছে না অর্থনীতি কবে স্বাভাবিক হবে।

কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলছেন, বিশ্ববাজারে চাপ কিছুটা কমে এলে মূল্যস্ফীতির হারও কমে আসবে। সরকার অনেক প্রণোদনা দিচ্ছে। সে জন্য বিপুল পরিমাণ ঋণ করতে হচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে পারে।

বিশ্ববাজারে খাদ্যমূল্য এখন এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও উৎপাদক দেশগুলোতে প্রতিকূল পরিবেশের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে বৈশ্বিক পণ্যমূল্য গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি ছিল। তেলের দাম প্রাক্‌-মহামারি পর্যায়ে চলে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। চীনসহ অন্যান্য উন্নত দেশে ধাতুর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে।

একই সঙ্গে জাহাজের ভাড়া এখন গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি। ২০২০ সালের শেষভাগ থেকে এই ভাড়া বাড়তে শুরু করে। অথচ করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ের পর ভোক্তাপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। জাহাজগুলো এখন পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে কনটেইনারের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। বন্দরে বন্দরে তৈরি হয়েছে জট। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অনেক বন্দর এখনো পুরোপুরি খোলেনি। চীনে করোনাভাইরাসের ডেলটা প্রজাতির সন্ধান মেলার পর তাদের অনেক বন্দর আংশিক বন্ধ রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে আছে সামাজিক দূরত্বের বিধান। এতে বন্দরে জাহাজিকরণ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। চলতি বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে জাহাজের ভাড়া আরও ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। ২০২২ সালের প্রথম দিকে তা স্থিতিশীল হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে এই প্রতিবেদনে। আর ২০২৩ সালের আগে জাহাজ পরিবহনের সক্ষমতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই।

এখন কথা হচ্ছে, জাহাজভাড়া ও অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি শেষমেশ ভোক্তার ওপর চাপবে আর তাতে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি বাড়বে। হিসাব করে দেখা গেছে, জাহাজভাড়া ও অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ধনী দেশগুলোর ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। অথচ ২০২০ সালের মধ্যভাগের পরে এসব কারণে উল্টো ভোক্তা মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ কমেছে।

সামগ্রিক হিসাবে দেখা যায়, ২০২০ সালের শেষ দিক থেকে যে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোক্তা মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, তার তিন-চতুর্থাংশই হয়েছে পণ্য ও জাহাজের ভাড়া বৃদ্ধির কারণে।

তবে সব দিন এক যাবে না। জি–২০ভুক্ত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের শেষ নাগাদ ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ থাকবে। ২০২২ সালের শেষ নাগাদ তা ৩ দশমিক ৫০ শতাংশে নেমে আসবে। তবে সেটাও মহামারির আগের সময়ের তুলনায় বেশি।

এ পরিস্থিতিতে ওইসিডি বলছে, মুদ্রানীতিতে এখনো অনেক কিছু সংকুলান করতে হবে। অর্থাৎ ছাড় দিতে হবে ঠিকই, কিন্তু মূল্যস্ফীতি কতটা সহ্য করা হবে, সে বিষয়ে পরিষ্কার দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। এই নীতি চিরকাল চালানো যাবে না। ধীরে ধীরে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কবে ও কীভাবে সেই নীতি থেকে বেরিয়ে আসা যাবে, সে জন্যও সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে ওইসিডি।