নিলামের নয়া রীতিতে নোবেল জয়

নিলামে উঠল ২০২০ সালের অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার—কথাটি শুনলে হয়তো অনেকের চোখ কপালে উঠবে। তবে খবরটি এভাবে দেওয়ার কারণ হলো, চলতি বছর যে দুজন অর্থনীতিবিদ নিজ শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের গবেষণার বিষয় ছিল নিলাম তত্ত্ব।

ব্যাপারটা হলো, কোনো পণ্যের নিলাম চলাকালীন পণ্যের দাম কীভাবে ওঠানামা করে, নিলামে অংশগ্রহণকারীদের আচরণই বা কেমন থাকে, পণ্য দরদাতাদের কীভাবে আকর্ষণ করে—এসব বিষয়ে তত্ত্বের হদিস দিয়ে এবার অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার জিতে নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই অর্থনীতিবিদ—পল আর মিলগ্রম ও রবার্ট বি উইলসন। দুজনই ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস সোমবার জানিয়েছে, শুধু নিলামের তত্ত্ব ও কার্যপদ্ধতি ব্যাখ্যাই নয়, নোবেলজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ নিলামের মাধ্যমে পণ্য বিপণনের বিকল্প পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছেন। এ বছরের নোবেল পুরস্কারের অর্থ ১১ লাখ ডলার।

নোবেল পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যান পিটার ফ্রেডরিখসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, এ বছরের অর্থনীতিতে যাঁরা নোবেল পেয়েছেন, তাঁরা মৌলিক তত্ত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন ঠিকই, তবে পরবর্তীকালে সেই ফলাফল বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করেছেন তাঁরা। তাঁদের উদ্ভাবন সমাজের প্রভূত উপকারে আসবে।

রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস আরও জানায়, নিলামের তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁরা সর্বোচ্চ দরপ্রত্যাশীদের সুবিধা করে দিতে চাননি, বরং যাঁরা সমাজের ভালো করতে চান, তেমন প্রকৃতির নিলামকারীদের হয়ে কাজ করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা বিভিন্ন ধরনের আন্তসম্পর্কিত পণ্যের নিলামের নতুন রীতি উদ্ভাবন করেছেন।

পুরস্কার কমিটির ভাষ্যমতে, যেসব জিনিসের সাধারণ মূল্য আছে, সেসব জিনিসের নিলামের রীতি প্রথম উদ্ভাবন করেন রবার্ট বি উইলসন। তিনি বলেছেন, দরদাতারা সাধারণত পণ্যের বেশি দাম হাঁকতে চান না। তাঁদের মনে ভয় থাকে, পাছে দাম বেশি পড়ে যায়। আর সেই জিনিস–সংক্রান্ত তথ্যের ঘাটতি থাকলে তো কথাই নেই—দর আরও কম হাঁকেন তাঁরা।

সিএনএন সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে মার্কিন সরকার প্রথম তাঁদের উদ্ভাবিত রীতি অনুসারে রেডিওর তরঙ্গ নিলামে তোলে। এতে করদাতাদের স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়। তবে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের কাছে তা অমূল্য সম্পদ।

পুরস্কার কমিটির ভাষ্যমতে, যেসব জিনিসের সাধারণ মূল্য আছে, সেসব জিনিসের নিলামের রীতি প্রথম উদ্ভাবন করেন রবার্ট বি উইলসন। তিনি বলেছেন, দরদাতারা সাধারণত পণ্যের বেশি দাম হাঁকতে চান না। তাঁদের মনে ভয় থাকে, পাছে দাম বেশি পড়ে যায়। আর সেই জিনিস–সংক্রান্ত তথ্যের ঘাটতি থাকলে তো কথাই নেই—দর আরও কম হাঁকেন তাঁরা। কিন্তু অধিকাংশ নিলামে দরদাতাদের ব্যক্তিগত ও সাধারণ বিবেচনা থাকে। যেমন—বাড়ি কেনার সময় ক্রেতা একদিকে ভাবেন, এই বাড়ি তাঁর মনের মতো কি না; আবার একই সঙ্গে তিনি ভাবেন, এই বাড়ির বাজারমূল্য কত।

ঠিক এখানেই মিলগ্রমের আবির্ভাব। সবাই নিলামে জিততে চায়—এই মনোভাব কীভাবে দর দেওয়ার সময় কাজ করে, তা খতিয়ে দেখেছেন তিনি। দেখলেন, মানুষ তথাকথিত ইংলিশ নিলামে কম দর দিয়ে শুরু করে দর বাড়াতে থাকে। অন্যদিকে ডাচ অকশন বা ডাচ নিলামে দরদাতারা শুরু করেন বেশি দর দিয়ে, পরে অবশ্য দর কমিয়েও থাকেন তাঁরা।

পুরস্কার কমিটি বলছে, এই দুই অর্থনীতিবিদের সবচেয়ে পরিচিত কাজ হলো, জটিল নিলামের জন্য নতুন রীতির প্রবর্তন করা। বিভিন্ন দেশের সরকার এখন যেভাবে টেলিকমগুলোকে তরঙ্গ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।

রেডিওর তরঙ্গ বরাদ্দের ব্যাপারটা একসময় সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার মতো ছিল। তাতে অপারেটররা নিজেদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতেন, কেন তাঁদের তরঙ্গ পাওয়া উচিত! আর শুরু হতো তীব্র লবিং। ৯০-এর দশকে মার্কিন ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন (এফসিসি) এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসার তোড়জোড় শুরু করে, কংগ্রেস তাতে সায়ও দেয়। তারা লটারির ভিত্তিতে তরঙ্গ বরাদ্দ করতে চাইল। তবে প্রাথমিকভাবে নতুন এই পদ্ধতি খুবই বাজে ফল দিল। লটারি হলো স্থানীয়ভাবে। ফলে অপারেটরদের নেটওয়ার্ক ভালো হলো না।

নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, মিলগ্রম ও উইলসন প্রবর্তিত রীতিতে বিভিন্ন অঞ্চলে একই সঙ্গে নিলামের সুযোগ সৃষ্টি হলো। নিলাম শুরু হতো কম দর দিয়ে, ধীরে ধীরে দর বাড়ত। এফসিসি ১৯৯৫ সালে এই রীতি গ্রহণ করে। এতে যেমন একসঙ্গে একাধিক অপারেটরকে তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হলো, তেমনি আগের চেয়ে বেশি টাকা তোলাও সম্ভব হলো। এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে একসময় শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ব্রিটেন, কানাডা ও স্পেনের মতো দেশও তা গ্রহণ করে।

গতকাল পুরস্কার ঘোষণার ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে উইলসন যুক্ত হলে জিজ্ঞাসা করা হয় ‘তিনি কখনো নিলামে কিছু কিনেছেন কি না’। উত্তরে প্রথমে না বললেও পরে স্ত্রী তাঁকে মনে করিয়ে দেন, নিলামে একবার স্কি বুট কিনেছিলেন তিনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একই সড়কে বাস করেন এই দুই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। পল আর মিলগ্রম স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবতা ও বিজ্ঞান বিভাগের ‘শিরলি অ্যান্ড লিওনার্ড এলি প্রফেসর’ পদে ১৯৮৭ সালে নিযুক্ত হন। তাঁর সহকারী রবার্ট বি উইলসন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরই ইমেরিটাস অ্যাডামস অধ্যাপক। ৮৩ বছর বয়স্ক রবার্ট উইলসনের জন্ম ১৯৩৭ সালে এবং ৭২ বছর বয়স্ক পল মিলগ্রমের জন্ম ১৯৪৮ সালে।