পাচার করা টাকা উদ্ধারে ভারতের সাফল্য সামান্য

পাচার করা টাকা উদ্ধারে ভারতে নেওয়া হয়েছিল একাধিক উদ্যোগ, কিন্তু সাদা হয়েছে অল্প অর্থ, দেশে ফেরেনি পাচার করা অর্থ।

  • স্বাধীন ভারতে দেশে-বিদেশে জমানো কালোটাকা সাদা করার ছোট-বড় ‘ক্ষমা প্রকল্প’ (অ্যামনেস্টি স্কিম) বেশ কয়েকটি নেওয়া হয়েছিল।

ইউটিউবে এখনো পাওয়া যায় ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদির সেই ভাষণ। ভরা জনসভায় জনতার কাছে তিনি প্রশ্ন রাখছেন, ‘আপনারা বলুন, আমাদের চুরি হয়ে টাকা ফেরত আসা উচিত কি না? কালোটাকা দেশে ফেরত আসা কি দরকার? এই চোর, লুটেরাদের এক এক পয়সা কেড়ে নেওয়া দরকার কি? এই টাকার ওপর জনতার অধিকার আছে না নেই? এই টাকা জনতার সেবায় খরচ হওয়া উচিত কি না?’ জনতার প্রবল সম্মতির মধ্যে মোদি বলছেন, ‘এই যে চোর, লুটেরাদের টাকা বিদেশি ব্যাংকে জমা রয়েছে, একবার ওই টাকা দেশে নিয়ে এলে হিন্দুস্তানের প্রত্যেক গরিবের কাছে ১৫-২০ লাখ টাকা এমনি এমনিই পৌঁছে যাবে।’

আট বছর কেটে গেছে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর সংকল্প রক্ষা করতে পারেননি। পারা যে কঠিনস্য কঠিন, এক বছরের মধ্যেই সেই বোধোদয় ঘটেছিল তাঁদের। নইলে, ২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলতেন না, ‘প্রত্যেকের ব্যাংক খাতায় ১৫ লাখ টাকা করে জমা দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদি দিয়েছিলেন, তা আক্ষরিক অর্থে ধরা ঠিক হবে না। ওটা ছিল কথার কথা। সবাই জানে, কালোটাকা কখনো ব্যক্তিবিশেষের ব্যাংক খাতায় জমা পড়ে না।’

বাংলাদেশে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবারের বাজেটে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরানোর যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তার কার্যকারিতা নিয়ে এই মুহূর্তে দেশ সরগরম। এই ক্ষেত্রে ভারতের অভিজ্ঞতা অবশ্য বিশাল আহামরি কিছু নয়। একাধিক উদ্যোগ এযাবৎ গৃহীত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা মোটামুটি সেই এক তিমিরে।

স্বাধীন ভারতে দেশে-বিদেশে জমানো কালোটাকা সাদা করার ছোট-বড় ‘ক্ষমা প্রকল্প’ (অ্যামনেস্টি স্কিম) বেশ কয়েকটি নেওয়া হয়েছিল। কোনোটিই তেমন সফল হয়নি। প্রথম মোটামুটি সফল প্রকল্পটি ছিল ১৯৯৭ সালের। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের উদ্যোগে ‘ভলান্টারি ডিসক্লোজার অব ইনকাম স্কিম’ (ভিডিআইএস) নামে এই প্রকল্প চালু হয়’ ৯৭ সালের ১ জুলাই। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ছয় মাস। ব্যক্তিগত ঘোষিত আয়ের ক্ষেত্রে ধার্য হয়েছিল ৩০ শতাংশ কর, কোম্পানির ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ। দেশজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অর্থ মন্ত্রণালয় এই প্রকল্প সার্থক করতে প্রচার চালিয়েছিল। ৯৭ সালের সেই সরকারি ক্ষমা প্রকল্পে সাড়া দিয়েছিলেন পৌনে ৫ লাখ মানুষ। তাঁদের অঘোষিত আয়ের পরিমাণ দেখানো হয়েছিল ৩৩ হাজার কোটি রুপি। সরকারি কোষাগারে কর জমা হয়েছিল প্রায় ৯ হাজার ৭৬০ কোটি রুপি। ভারতীয় অর্থনীতির বহরের তুলনায় যা নগণ্য। প্রকল্প শেষ হলে তার কার্যকারিতা কতটুকু, শুধু সেটাই যে বোঝা গিয়েছিল তা নয়, পরবর্তী সময়ে ‘কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল’–এর (সিএজি) রিপোর্টে ওই প্রকল্পকে ‘দেশের সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার’ বলেও মন্তব্য করা হয়েছিল।

কালোটাকা উদ্ধার করে দেশের সব গরিবের ব্যাংক খাতা ভরে দেওয়া লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদির অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ২০১৬ সালের বাজেটে আনেন ‘ইনকাম ডিক্লারেশন স্কিম’ (আইডিএস) বা আয় ঘোষণা প্রকল্প। তিনি জানিয়েছিলেন, চার মাসের ওই বিশেষ প্রকল্প কোনো ক্ষমা প্রকল্প নয়। তবে অঘোষিত ‘কালো’টাকা ‘সাদা’ করার এক উপায়। সেই বছর অক্টোবর মাসে অরুণ জেটলি জানান, সরকারের ওই প্রকল্পে ঘোষিত হয়েছে মোট ৬৫ হাজার ২৫০ কোটি টাকার অঘোষিত সম্পদ, যা থেকে কর, সেস ও জরিমানা বাবদ সরকারের আয় হয়েছে ২৯ হাজার ৩৬২ কোটি রুপি।

দিল্লিভিত্তিক অর্থনীতিবিষয়ক থিঙ্ক ট্যাংক ‘রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস’-এর সিনিয়র গবেষক শুভময় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘অসৎ ব্যক্তিদের এভাবে বাবা-বাছা করা সৎ করদাতাদের অসৎ হতে উৎসাহ দেবে। তা ছাড়া অর্থ পাচারকারীরা মনে করতে পারেন, এসব প্রকল্প সরকারের ফাঁদ। একবার পা দিলে পরে কোনো না কোনো সময়ে তাঁদের বিপদে পড়তে হতে পারে। সে কারণে কোনো দেশেই এসব প্রকল্প খুব একটা সফল হয়নি।’ তাঁর মতে, অর্থ পাচার রোখার একমাত্র উপায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আঁটুনি বজ্র কঠিন করা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা।