বছরের শেষ ভাগে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে

খাদ্য ব্যয় বৃদ্ধি অবস্থাপন্ন মানুষের জন্য বড় সমস্যা না হলেও দরিদ্র মানুষের জন্য বড় সমস্যা।

সারা বিশ্বেই পণ্যের মূল্য বাড়ছে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকে। আবার এ সমস্যার শিগগির সমাধান হচ্ছে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলেছে, খাদ্যশস্য ও তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খাদ্যের মূল্য এখন ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক দাঁড়িয়েছে ১৩০। অথচ গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ৯৭ দশমিক ৯ শতাংশ। খাদ্য ব্যয় বৃদ্ধি অবস্থাপন্ন মানুষের জন্য বড় সমস্যা না হলেও দরিদ্র মানুষের জন্য তা বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। কারণ, আনুপাতিক হারে দরিদ্র মানুষের খাদ্য ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, মহামারি শুরুর পর সারা বিশ্বে খাদ্যমূল্য ৪০ শতাংশ বেড়েছে (মূল্যস্ফীতি সমন্বিত নয়)। তবে এ বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় উন্নত দেশগুলোতেই মূল্যস্ফীতির হার বেশি। আইএমএফের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ উন্নত দেশগুলোর সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াতে পারে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে আর সামগ্রিকভাবে এ বছর তা দাঁড়াতে পারে ২ দশমিক ৮ শতাংশে। গত বছর একই সময়ে যা ছিল শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে তা দাঁড়াতে পারে প্রায় ২ শতাংশে।

মহামারির মধ্যে বিভিন্ন দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। অনেক দেশেই কাঁচামালের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। শস্য থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল—সবকিছুর উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ বা স্বাস্থ্যবিধির কারণে উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে।

কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এখন অর্থনীতি স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে। উন্নত দেশের সরকার মানুষকে যে নগদ সহায়তা দিয়েছে, তাতে মানুষের সঞ্চয় বেড়ে গেছে। অর্থাৎ খরচ করার মতো অনেক টাকাই এখন তাদের হাতে আছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে জ্বালানির দাম। অনেক দেশে মজুরিও বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে উৎপাদকেরা চাপেরমুখে পড়েছেন।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাহাজ পরিবহন–সংকট। হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যমান জাহাজবহর দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধির কারণে অনেক বন্দরে পণ্য খালাসে সময় লেগে যাচ্ছে। এসব কারণে সারা বিশ্বে খাদ্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

সম্প্রতি ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ বলেছেন, বিশ্ব এক প্রলম্বিত অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। মহামারি দীর্ঘ হওয়ার কারণেই অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ অনিশ্চয়তার জের আগামী বছরেও কিছুটা থাকবে। এরপর ধীরে ধীরে তা কমে আসবে। আর এখন যে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তা মূলত সরবরাহজনিত, চাহিদাজনিত নয়। সরবরাহসংকট তৈরি হওয়ার জন্য এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে সুদহার বাড়িয়ে এ সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তবে এ সমস্যা বেশি দিন থাকবে না বলেই মনে করেন তিনি।

মূল্যস্ফীতির প্রভাব বেশ জটিল বলেই মনে করে আইএমএফ। উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বাড়তি থাকলে সরকার প্রণোদনা তুলে নেবে। এতে আর্থিক বাজার ব্যাহত হতে পারে। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি বাড়তি থাকলে পুঁজি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সঙ্গে থাকে মুদ্রার বিনিময় হার কমে যাওয়ার শঙ্কা। এ ছাড়া শ্রম আয়ের ওপর নির্ভরশীল নিম্ন আয়ের মানুষেরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই মানুষদের ব্যয়ের বড় একটি অংশ চলে যায় খাদ্যের পেছনে। ফলে উচ্চ বা মধ্যম আয়ের মানুষেরা তেমন আক্রান্ত না হলেও নিম্ন আয়ের মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বৈষম্য বেড়ে যায়।

তবে চলমান মূল্যস্ফীতি সরবরাহসংকটের কারণে সৃষ্ট বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে কিছু করার সুযোগ সীমিত। এ পরিস্থিতিতে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের ওপরই সরকারের জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।