বাংলাদেশ চাল আমদানিতে নামল, বিশ্ববাজারেও দাম বাড়ল

৩০০ প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন চালের দাম ১০ থেকে ১৫ ডলার বেড়ে গেছে।

  • সরকারি গুদামে গতকাল বৃহস্পতিবার মজুত ছিল পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার টন।

  • গত বছর একই সময়ে মজুত ছিল ১১ লাখ ৫০ হাজার টন।

  • এক সপ্তাহ আগে ভারত প্রতি টন সেদ্ধ চাল আর্ন্তজাতিক বাজারে ৩৮০ ডলারে বিক্রি করেছে। গতকাল তা বেড়ে ৩৯০ ডলারে দাঁড়িয়েছে।

  • আন্তর্জাতিক বাজারে আতপ চালের দাম ৩৮৪ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০০ মার্কিন ডলার। গত জুলাই–আগস্টে সেদ্ধ ও আতপ চাল ৩৬০ থেকে ৩৬৫ ডলারে বিক্রি হয়েছে।

চাল
ফাইল ছবি

বিশ্ববাজারে চালের দাম হঠাৎ বাড়তে শুরু করেছে। প্রধান চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান প্রায় প্রতিদিনই চালের রপ্তানিমূল্য বাড়াচ্ছে। এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম প্রতি টনে ১০ থেকে ১৫ ডলার বেড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ আলাদা দুটি প্রতিবেদনে চালের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরেছে। দুটি সংস্থার প্রতিবেদনই বলছে, বাংলাদেশ শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানি শুরু করায় হঠাৎ দাম বাড়তে শুরু করেছে।

অন্যদিকে ঢাকায় গতকাল বৃহস্পতিবার খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও প্রায় একই চিত্র উঠে এসেছে। ‘দৈনিক খাদ্য পরিস্থিতি’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক সপ্তাহে ভারতীয় চালের দাম কেজিতে ১ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী গত ৬ আগস্ট যখন চাল আমদানির অনুমতি দেন, তখন বিশ্ববাজারে চালের দাম ছিল কম। দেশেও মোটা চালের কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে ছিল। আমন ধান তখনো কাটা শেষ হয়নি। ওই সময়ে আমদানি শুরু করলে দেশে পর্যায়ক্রমে চাল আসত। ফলে দাম হঠাৎ করে এভাবে বাড়ত না। এখন বাংলাদেশে একসঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই আমদানি শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে দ্রুত দাম বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দেওয়ার সময় থেকে এখন বিশ্ববাজারে চালের দাম টনপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ ডলার বেশি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক কৃষিসচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় চালের মজুত গড়ে তোলা ও আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে শুরু করে শুল্ক আরোপ প্রতিটি বিষয়ে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তারা যখন চাল আমদানি করা উচিত ছিল, তখন বসেছিল। আর বিশ্ববাজারে যখন দাম বাড়ছে, তখনই আমদানি শুরু করায় দাম আরও বেড়ে গেছে। এতে চাল আমদানির লক্ষ্য পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

এদিকে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হলেও খুচরা বাজারে তার তেমন প্রভাব পড়েনি। মোটা চাল এখনো ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ঢাকার পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি ১ থেকে ২ টাকা দাম কমেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। গত এক সপ্তাহে দেশের প্রধান মোকামগুলোয় ধানের দাম ওঠানামা করছে। গত এক সপ্তাহে মণপ্রতি দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কমলেও গত দুই দিনে তা আবার ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৩ থেকে ১০ জানুয়ারির মধ্যে আবেদন করা ৩০০–এর মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাদের এক মাসের মধ্যে চাল আমদানির শর্ত দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খাদ্যসচিব নাজমানারা খানুম প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি করা চাল দ্রুত বাজারে আসবে। তখন চালের দাম কমতে শুরু করবে।

এদিকে প্রথম আলোকুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, সেখানকার মোকামে এক মাস ধরে চালের দাম অপরিবর্তিত আছে। প্রতি কেজি মোটা চাল ৩৯ টাকা, কাজললতা ৪৮ টাকা ও মিনিকেট ৫৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

দেশে পাইকারি দামে চাল বেচাকেনার প্রধান দুই এলাকা নওগাঁ ও কুষ্টিয়ায় ধান এবং চালের সরবরাহ কমেছে। বেচাকেনাও কম। নওগাঁ ও কুষ্টিয়া জেলার হাট ও মোকামগুলোয় প্রতি মণ মোটা চালের ধান ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জানতে চাইলে নওগাঁ অটো, মেজর, হাসকিং ও মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘বাজারে ধানের দাম কমছে না, বরং বাড়ছে। তাহলে আমরা চালের দাম কীভাবে কমাব।’

ইউএসডিএ থেকে গত বুধবার প্রকাশ করা ‘গ্রেইন: ওয়ার্ল্ড মার্কেট অ্যান্ড ডিমান্ড–২০২১ জানুয়ারি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ হঠাৎ করে সরকারিভাবে ৫ থেকে ৭ লাখ টন চাল আমদানির ঘোষণা দিয়েছে। বেসরকারি খাতকেও সুযোগ দিতে আমদানি শুল্ক ৬৭ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বেসরকারি খাতের মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি হতে পারে।

বাংলাদেশ মূলত ভারত থেকে ওই চাল আনবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানের তুলনায় ভারতের চালের দাম কম। আর ওই চাল ট্রাক ও ট্রেনে করে আনা যাবে। ফলে দ্রুত আমদানি করতে পারবে।

সরকারের উচিত বেসরকারি খাতে সীমিত সুযোগ দিয়ে নিজে বেশি আমদানি করা, যাতে সরকারি গুদামে মজুত বৃদ্ধি পায়।
এম আসাদুজ্জামান , বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক

এদিকে বিশ্বের অন্যতম চাল রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনামও এক যুগ পর এবার চাল আমদানি করছে। এর প্রভাবও পড়েছে বৈশ্বিক চালের বাজারে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের উচিত বেসরকারি খাতে সীমিত সুযোগ দিয়ে নিজে বেশি আমদানি করা, যাতে সরকারি গুদামে মজুত বৃদ্ধি পায়।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সরকারি গুদামে গতকাল বৃহস্পতিবার মজুতের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৩৬ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১১ লাখ ৫০ হাজার টন। এক সপ্তাহ আগে ভারত প্রতি টন সেদ্ধ চাল আন্তর্জাতিক বাজারে ৩৮০ ডলারে বিক্রি করেছে। গতকাল তা ৩৯০ ডলারে উঠেছে। আতপ চালের দাম টনপ্রতি ৩৮৪ থেকে বেড়ে ৪০০ ডলার হয়েছে। আর গত জুলাই–আগস্টে সেদ্ধ ও আতপ চাল ৩৬০ থেকে ৩৬৫ ডলারে বিক্রি হয়েছিল।

বাজারে যথেষ্ট পরিমাণে ধান–চাল আছে, সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই।
শাহজাহান কবির , ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমন মৌসুমে দেশে কয়েক দফা বন্যার কারণে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ লাখ টন কম হয়েছে। তারপরও আগামী জুন পর্যন্ত চাল নিয়ে কোনো ঘাটতির আশঙ্কা নেই। কারণ, চাহিদার তুলনায় দেশে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টন বাড়তি চাল আছে।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শাহজাহান কবির প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে যথেষ্ট পরিমাণে ধান–চাল আছে, সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই।

গত জুলাই–আগস্টের বন্যার পর থেকেই দেশে চালের দাম বাড়তে থাকে। কেজিপ্রতি দাম ৪০ থেকে বেড়ে ৫০ টাকার ঘরে পৌঁছায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নিজস্ব উদ্যোগে চাল আমদানি করছে এবং শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি খাতকে সুযোগ দিয়েছে।