বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের যাত্রা শুরু

নতুন বছরের শুরুতেই আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (এফটিএ) চুক্তি কার্যকর করল আফ্রিকা। ফলে মহাদেশটিতে বাণিজ্য বাড়বে ও দারিদ্র্য কমবে।

করোনা কয়েক মাস বিলম্ব ঘটালেও অবশেষে নতুন বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের প্রথম দিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (এফটিএ) চুক্তি কার্যকর হলো আফ্রিকায়। বদৌলতে আফ্রিকা মহাদেশই এখন বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল।

এ জন্য ২০২০ সালের মার্চে সই হয় আফ্রিকান কন্টিনেন্টাল ফ্রি ট্রেড এরিয়া বা আফ্রিকা মহাদেশীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (এসিএফটিএ) চুক্তি, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড–১৯ অতিমারির কারণে সদস্যদের মধ্যে আলোচনা–সমঝোতা কঠিন হয়ে পড়ায় চুক্তি কার্যকর করার তারিখ পিছিয়ে যায়।

এসিএফটিএ চুক্তির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, আফ্রিকা মহাদেশের ১২০ কোটি মানুষকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা। আফ্রিকার ৫৫টি দেশের সব কটিতে এই মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল চুক্তি কার্যকর হলে তাদের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ লাখ কোটি ডলার। বর্তমানে সম্মিলিতভাবে আফ্রিকা মহাদেশের অর্থনীতির আকার ৩ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন বা ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। উল্লেখ্য, এক ট্রিলিয়ন সমান এক লাখ কোটি।

বর্তমানে আফ্রিকার দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের মাত্র ১৬ শতাংশ হয় নিজেদের মধ্যে। শুল্ক বাধাগুলো প্রত্যাহার হলে এই হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে জানায় ইকোনমিক কমিশন ফর আফ্রিকা (ইসিএ)। অন্যান্য মহাদেশের মধ্যে লাতিন বা দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯ শতাংশ, এশিয়ায় ৫১ শতাংশ, উত্তর আমেরিকায় ৫৪ শতাংশ ও ইউরোপে ৭০ শতাংশ বাণিজ্য হয় নিজেদের মধ্যে।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রাক্কলনে বলা হয়েছে, মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (এফটিএ) চুক্তি কার্যকর হওয়ার ফলে আগামী ২০৩৫ সাল নাগাদ মহাদেশটির অন্তত এক কোটি মানুষ দরিদ্র অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে।

গত শুক্রবার অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আয়োজিত এসিএফটিএর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ঘানার প্রেসিডেন্ট ন্যানা আকুফো–আদ্দো বলেন, ‘নতুন আকাঙ্ক্ষা, উদ্দেশ্য ও তাগিদ অনুভব করার মধ্য দিয়ে এবারে নতুন আফ্রিকার যাত্রা শুরু হলো, যাতে স্বনির্ভর হয়ে ওঠা যায়।’

তবে কিছু দেশে লালফিতার দৌরাত্ম্য, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও রক্ষণশীলতা ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তাই বাণিজ্য সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানোর লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এসব বাধা দূর করতে হবে।

এসিএফটিএ সচিবালয়ের মহাসচিব ওয়েমকেলে মেনে বলেন, ‘কোভিড–১৯ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে আফ্রিকা প্রাথমিক পণ্য রপ্তানি এবং বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থার ওপর কতটা নির্ভরশীল। যখন বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হলো তখন আমরা দেখলাম, আফ্রিকা ধুঁকছে।’

সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের (সিজিডি) ফেলো ও লাইবেরিয়ার সাবেক মন্ত্রী ডব্লিউ গাইদে মুর মনে করেন, বাণিজ্য চুক্তির প্রকৃত কাজগুলো কেবলই শুরু হয়েছে। তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘আমি তখনই বিস্মিত হব, যদি দেখি সবকিছু ২৪ মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে গেছে।’

ঐতিহাসিকভাবেই আফ্রিকা দুর্বল সড়ক ও রেল যোগাযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সীমান্ত নিয়ে অত্যধিক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি—এসব সমস্যায় জর্জরিত এক মহাদেশ। এগুলো রাতারাতি কেটে যাবে না।

চুক্তির কার্যকারিতা শুরু হলেও আফ্রিকায় এখনো অবাধ বাণিজ্যের জন্য কতটা প্রস্তুত, সেই প্রশ্নও অবশ্য রয়েছে। কারণ, বাণিজ্যের জন্য বেশ জরুরি, এমন কিছু বিষয় এখনো সুরাহা হয়নি। যেমন বাণিজ্য ও সেবা প্রটোকল, মেধাস্বত্ব, লস অব অরিজিন বা পণ্যের উৎসবিধি, শুল্ক–করের হার, বিনিয়োগ নীতিমালা ও প্রতিযোগিতা।

চুক্তির আওতায় নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্যে আফ্রিকার দেশগুলোকে অবশ্যই ৯০ শতাংশ ট্যারিফ বা শুল্ক তুলে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো ৫ বছর ও অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশগুলো ১০ বছর সময় পাবে।

সীমান্ত বাণিজ্য সহজ করা নিয়ে কাজ করা বর্ডারলেস অ্যালায়েন্সের জিয়াদ হ্যামোই বলেন, ট্যারিফের বিষয় যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করা উচিত।

তবে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকায় বিভিন্ন দেশের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়তে পারে ট্যারিফ কমানোর প্রক্রিয়া।

এসিএফটিএর চিফ অব স্টাফ সিলভার ওজাকল বলেন, ‘অর্থনীতি সমন্বিতকরণ কোনো ঘটনা নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া। তাই আমারা কোথাও এক জায়গা থেকে শুরু করলাম।’

সূত্র: ইউএন ওআরজি, আল–জাজিরা