বেজোসের সভায় খালি চেয়ারে থাকেন গ্রাহক

কোম্পানির নির্বাহীরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মিটিং বা সভায় যোগ দিলে পরিকল্পনা ভালো হয়, সফলতা আসে। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ আমাজন।

জেফ বেজোস, অ্যান্ডি জ্যাসি

কর্মস্থলে মিটিং বা সভা করা নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। কেউ মনে করেন, মিটিং ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণই সম্ভব নয়, আবার কারও কারও ধারণা, মিটিং মানেই সময়ের অপচয়। তবে কর্মক্ষেত্রে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি কার্যকর করা যায়, তাহলে একটি প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি যে যথেষ্ট মজবুত হয়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স কোম্পানি আমাজন। বিশ্বের শীর্ষ ধনী জেফ বেজোস তাঁর এই সুবৃহৎ কোম্পানিতে যেভাবে মিটিং করেন, তা বেশ শিক্ষণীয়।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহৎ কোম্পানি আমাজন। এর প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস প্রতিদিন দুপুরের খাবারের আগেই একটি ‘উচ্চ আইকিউ’ সমৃদ্ধ মিটিংয়ের শিডিউল বানিয়ে ফেলেন। তাঁর মতে, দিনে যদি মাত্র তিনটি কার্যকর সিদ্ধান্তও নেওয়া যায়, তবে তা-ই যথেষ্ট।

বেজোসের মিটিং

গ্রাহক ঠিক কী চান, সেটির ওপর ফোকাস করা বা জোর দেওয়াই বেজোসের মূল লক্ষ্য। এ জন্য একদম শুরু থেকেই আমাজনের অভ্যন্তরীণ মিটিং বা বৈঠকগুলোতে একটা চেয়ার খালি রেখে আসছেন তিনি। এতে বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা ভাবেন, চেয়ারটিতে কোনো একজন গ্রাহক বসে আছেন। আর ওই গ্রাহক বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে কী ভাবছেন, তা আলোচনার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করেন আমাজনের কর্তাব্যক্তিরা।

বেজোস যখন প্রথমবারের মতো বই ও গানের সিডি বিক্রির বাইরে নতুন ব্যবসা প্রসারের কথা ভেবেছিলেন, তখন তিনি এক হাজারের বেশি গ্রাহককে গ্রুপ ই–মেইল করেছিলেন। ওই মেইলে বেজোস জানতে চান, তাঁরা আমাজনের ই-কমার্স সাইট থেকে কী কী কিনতে চান। গ্রাহকদের প্রতিক্রিয়া থেকে বেজোস এই সিদ্ধান্তে আসেন, চাইলে তিনি অনলাইনে যেকোনো কিছুই বিক্রি করতে পারেন। ব্যস, সেটিই করেছেন তিনি। এভাবে পরবর্তীকালেও গ্রাহক চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বেজোস।

নেতৃত্বে জোর

লিডারশিপ ফোকাস করে বা নেতৃত্বের ওপর জোর দিয়ে কাজ করা গবেষণা সংস্থা ড্রুকার ইনস্টিটিউট ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা সংস্থা হিসেবে আমাজনের নাম ঘোষণা করে। আমাজনের সবচেয়ে বড় গুণ হলো, নতুন উদ্ভাবনের দিকে কোম্পানির তীব্র ফোকাস। তারা মনে করে, ব্যর্থতা ও নতুনত্ব একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। পার্থক্য কেবল ব্যর্থতার ফল ভালো হলো না খারাপ হলো, তাতে। এটা মাথায় রেখেই মিটিং সফল করতে বদ্ধপরিকর বেজোস। তাঁর কোম্পানির মিটিংয়ের আগে ছয় পৃষ্ঠার একটি মেমো লেখা হয়, যা পাওয়ার পয়েন্টে দেখানো হয় না, বরং মিটিংয়ে উপস্থিত সবাই সেটি মনোযোগ দিয়ে পড়েন। এরপর তা নিয়ে আলোচনা হয়। ওই মেমোর প্রস্তাব মিটিংয়ে বসেই কাটাছেঁড়া বা সংযোজন-বিয়োজন করা হয়। কর্মীরা পুরো সপ্তাহ নানা চিন্তাভাবনার আলোকে ওই মেমো তৈরি করেন। এতে তাঁদের চিন্তাভাবনা দিন দিন আরও তীক্ষ্ণ হয়।

* আমাজনের বৈঠকে একটা চেয়ার খালি রাখা হয়। আর ভাবা হয়, ওই চেয়ারে একজন গ্রাহক বসে আছেন। * পরিকল্পনা কতটা প্রয়োগ সম্ভব, তা খতিয়ে দেখা হয়। এরপর সবাই নিজ নিজ পরিকল্পনা দেন।

অ্যান্ডি জ্যাসির কাটাকুটি

আমাজনের ২৭ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে পরিবর্তন আসছে। জেফ বেজোসের জায়গায় আগামী জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে অ্যান্ডি জ্যাসি যে বসবেন, তা এখন অনেকেরই জানা। অ্যান্ডি জ্যাসি বর্তমানে আমাজনের ক্লাউড কম্পিউটিং বিভাগ আমাজন ওয়েব সার্ভিসেসের (এডব্লিউএস) সিইও। অন্যতম এই সফল বিভাগ তাঁরই হাতে গড়া। সামনে তিনি কেমন মিটিং করেন, তা জানতে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। তাঁর একটি সম্মেলনকক্ষ রয়েছে, যেটির নাম ‘দ্য চপ’ বা কাটাকুটি করার কক্ষ। এতে অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। এটি হলো, সিদ্ধান্ত কাটাকুটি করে একটি উপযুক্ত আকার দেওয়া হয়। কক্ষটিতে অনুষ্ঠিত ব্যবস্থাপনা বৈঠক থেকে অন্য নির্বাহীরা কিছু শিখতেও পারেন। তবে বসের সঙ্গে মিটিংয়ের আগে কর্মীরা ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। মেমো তৈরি হয়। মেমোগুলো বারবার পর্যালোচনা করা হয়। এরপর কিছুদিন তা সরিয়ে রাখা হয়, পরে আবার সম্পাদনা করা হয়।

যেভাবে মেমো তৈরি হয়

মেমোতে কী প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে একটি ছোট্ট ভূমিকা থাকে। এরপর থাকে ব্যবসায়িক লক্ষ্য, ব্যবসায়ের অবস্থা (কেন প্রকল্পের প্রয়োজন), আগের অবস্থান এবং কৌশলগত অগ্রাধিকার (পরের বছর কী করা হবে) ইত্যাদি। এসব নিয়ে অ্যান্ডি জ্যাসির ‘চপ কক্ষে’ পর্যালোচনা হয়। বাস্তবে সেগুলো কতটা প্রয়োগ সম্ভব, তা খতিয়ে দেখা হয়। এরপর উপস্থিত সবাই নিজস্ব পরিকল্পনা দেন। এটি অবশ্য কোনো বুদ্ধিদীপ্ত সভা নয়। এখানে নতুন লক্ষ্যও নির্ধারিত হয় না; বরং মেমো কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব, তা তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে পরীক্ষা করা হয়।

প্রস্তুতি আছে তো ফল ভালো

বেজোসদের মানে আমাজনের মিটিংয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্য কোম্পানিগুলো তা করতেই পারে। কিন্তু এ জন্য সবার প্রস্তুতি থাকতে হবে। কর্মীরা প্রস্তুতি ছাড়া বৈঠকে গেলে তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না। কারণ, এভাবে নিয়ম পালনের জন্য বা নামকাওয়াস্তে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলো সাধারণত দুর্বল হয়। এতে প্রতিষ্ঠানের সময় ও অর্থের অপব্যয় হয়। এ ক্ষেত্রে আমাজন কী করে? বৈঠকের আগে আমাজনের কর্মীরা প্রস্তাবগুলোর প্রভাব সম্পর্কে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেন। তাই তো তাঁদের সিদ্ধান্তগুলো আমাজনকে নিয়ে গেছে সাফল্যের শিখরে।

সূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, বিজনেস টাইমস।