বৈশ্বিক এই মূল্যস্ফীতি সাময়িক

ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ের পর সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে। আর তাতে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। এবারের মূল্যস্ফীতির মূল দিকটা হলো, এটি মূলত সরবরাহ–সংকটজনিত মূল্যস্ফীতি, সাধারণ চাহিদা বৃদ্ধিজনিত নয়। ফলে এই মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গলদঘর্ম হচ্ছে।

এবার মহামারির ধাক্কা সামলে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সময় চমকপ্রদ কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সেটা হলো, পণ্যমূল্য ও মজুরি—দুটিই বাড়ছে। গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘণ্টাপ্রতি মজুরি বেড়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে মূল্যস্ফীতির কারণে সেই বৃদ্ধির সুফল মিলছে না। এ সময়ে ভোক্তা মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪। জার্মানিতে এ সময় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১। সে কারণে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির দাবি করছে। জাপানেও একই ধারা দেখা যাচ্ছে।

পুনরুদ্ধারের এই পর্যায়ে চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও সরবরাহব্যবস্থা তার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। মূলত সে কারণেই এই মূল্যস্ফীতি।

এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর গলদঘর্ম হওয়ার জোগাড়। বিশ্বের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক একই সুরে বলছে, এই মূল্যস্ফীতি সাময়িক। কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, অতিরিক্ত মজুরি বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বাড়তে পারে। ভবিষ্যতে জীবনযাপনের ব্যয় আরও বেড়ে যাবে, এই আশঙ্কায় শ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধি দাবি করলে, বিষয়টি আরও ঘোলাটে হয়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বিশ্বের অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বৃদ্ধি করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো সে পথে হাঁটেনি।

কারা কী ব্যবস্থা নিল

উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ে তেমন চিন্তিত না হলেও উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে এ নিয়ে সব সময় দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। সমস্যা হলো, উন্নয়নশীল দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাধিক্য, যাদের ব্যয়ের একটি অংশ চলে যায় খাদ্য বাবদ। সে কারণে আগস্ট মাসে ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরো ১ শতাংশ সুদ হ্রাস করেছে। এর আগে মার্চ থেকে চার দফায় সুদ বৃদ্ধি করেছে। এর আগে জুলাই মাসে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ ১ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। এ নিয়ে চলতি বছর তারা চারবার সুদহার বৃদ্ধি করল। শুধু মূল্যনিয়ন্ত্রণ নয়, বিনিয়োগকারীদের তারা জানান দিতে চায়, বিনিয়োগ আকর্ষণে মূল্যস্ফীতি বশে রাখতে চায় তারা।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সম্প্রতি বলেছে, মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে তারা ব্যবস্থা নেবে। তবে কবে নাগাদ সুদহার বাড়ানো হবে, তেমন ইঙ্গিত তারা দেয়নি। তবে দেশটির বিনিয়োগকারীরা আশা করছেন, এ বছরের শেষ নাগাদ বা ২০২২ সালের শুরুতে সুদহার বৃদ্ধি করা হবে। এর মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতির হার ৪ থেকে ২-এ নামিয়ে আনা হবে। উন্নত দেশে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা থাকে সাধারণত ২ শতাংশ।

বিপদ হলো, বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। ফলে এখন তাদের সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়, যাতে ভুগতে থাকা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন ঋণ নিয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এখন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে তারা সুদহার বৃদ্ধি করলে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। আবার মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া হয়ে গেলে মানুষ খরচ করতে নিরুৎসাহিত হবে। এতে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ তাই অত্যন্ত জটিল ব্যাপার, অনেকটা দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটার মতো, একটু পিছলে গেলেই বিপদ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করতে পারে

মূল্যস্ফীতির হার লাগামছাড়া হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রার লাগাম টেনে ধরতে সুদহার বৃদ্ধি করে। এতে মানুষ সঞ্চয়ে আগ্রহী হয়, কিন্তু বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়। মহামারির মধ্যে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারলে সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার তেমন কিছু নেই।

বেইস ইফেক্ট

উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই প্রবণতা সাময়িক বলে মনে করছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো। সম্প্রতি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস প্রকাশ অনুষ্ঠানে আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ বলেছেন, এটা সরবরাহ–সংকটজনিত সমস্যা, ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে তা থিতিয়ে আসবে। এর আগে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিনা ল্যাগার্ড বলেছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই ধারা ক্ষণস্থায়ী। কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, গত বছর বিধিনিষেধের সময় মূল্যস্ফীতির হার অনেক কম থাকায় এখন দাম অনেক বেশি মনে হচ্ছে। যেমন, গত বছর এপ্রিল মাসে জ্বালানির তেলের দাম মাইনাস ৩৭ ডলারে নেমে এসেছিল, এখন যা আবার ৮০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই মূল্যবৃদ্ধি বিপুল। কিন্তু ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় এই সেপ্টেম্বরে দাম বেড়েছে ১৯ শতাংশ। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তা-ই, অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলে বেইস ইফেক্ট।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির যুগ

তবে আইএমএফের এই মতের বিরোধী মতও পাওয়া গেছে। ব্যাপারটা হলো, ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর এক দশকের বেশি সময় ধরে সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি কম ছিল। কিন্তু সেই দিন বোধ হয় শেষ হতে চলেছে। ‘দ্য গ্রেট ডেমোগ্রাফিক রিভার্সাল: এজিং সোসাইটিজ, ওয়েনিং ইনইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড ইনফ্লেশন রিভাইভাল’ শীর্ষক বইয়ে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের মুদ্রানীতি বিভাগের সাবেক সদস্য চার্লস গুডহার্ট ও মর্গ্যান স্ট্যানলির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোজ প্রধান বলেছেন, ‘বর্তমানে আমরা যে নিম্ন মূল্যস্ফীতির জমানায় বসবাস করছি, তা সম্ভবত শেষ হতে যাচ্ছে। আগামী ২০-৩০ বছরে চীন ও পশ্চিমা পৃথিবীতে জাপানের মতো বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে।

এতে স্বাভাবিকভাবে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বাড়বে। অর্থাৎ, যত মানুষ কাজ করবে, তার চেয়ে বেশি মানুষ কর্মক্ষম মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। মহামারি সামলাতে এবং বয়স্ক লোকজনকে ভরণপোষণ দিতে দেশে দেশে ঋণের বোঝা বাড়বে। এর সঙ্গে বিশ্বায়ন বিরোধিতার পালে আরও হাওয়া লাগবে, সরবরাহব্যবস্থার সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ নিজ দেশে কারখানা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। তখন কম শ্রমিক বেশি কাজ করবে। দেশে কারখানা এলে শ্রমিকদের মজুরি বাড়বে। কমবে অসমতা, বাড়বে মূল্যস্ফীতি।