মন্দায় মন্দায় যে অর্থনৈতিক সংকট

  • গত ১১ বছরে সবচেয়ে বড় মন্দায় পড়েছে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি। দেশটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে।

  • যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে মন্দার সূচনা ফেব্রুয়ারি থেকে। প্রথম প্রান্তিকে জিডিপির পতন হয় ৫ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে কমেছে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ।

  • করোনার কারণে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ সবশেষ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, যেমনটি ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়েও খারাপ অবস্থায় যাচ্ছে এই ব্লকের অর্থনৈতিক অবস্থা।

শেয়ারবাজার ধসের এই ছবিটি ১৯৯৭–এর এশিয়ার সংকটের সময়ের

২০০৬ সালে বেলুনের মতো ফুলে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের গৃহায়ণ খাতের পতন থেকেই শুরু হয়েছিল ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট। ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী সেই অর্থনৈতিক সংকটের সবচেয়ে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থবাজারে। দেউলিয়া হয় অসংখ্য কোম্পানি। সেই সংকট থেকে উত্তরণ হওয়ার যুগ পার না হতেই আরেকটি বড় সংকটে বিশ্ব। প্রাণহানির বিষয়টি ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটে প্রাসঙ্গিক ছিল না। সেই সঙ্গে ঘরবন্দী হওয়ার ব্যাপারও ছিল না। তাই বলা যায়, অতীতের সব সংকটের চেয়ে করোনা মহামারির কারণে যে সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে, তা একেবারেই ভিন্ন।

অর্থনীতি মন্দায় পড়ে কখন

সাধারণ সময়ে একটি দেশের অর্থনীতি বাড়তে থাকে। এর নাগরিকের, দেশের উৎপাদিত পণ্য ও পরিষেবার মূল্য অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়ও কিছুটা বাড়ে। তবে কোনো কোনো সময় উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মূল্য কমেও যায়। একটি অর্থবছরের পরপর কয়েকটি প্রান্তিকে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সূচক যদি নিম্নমুখী হয়, তবেই মূলত মন্দার লক্ষণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), শিল্প উৎপাদন, চাকরির বাজারসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক সম্প্রসারণের বদলে সংকোচনের লক্ষণ দেখা দিলেই শঙ্কাটি তৈরি হয়।

মন্দায় পড়েছে যেসব দেশ

গত ১১ বছরে সবচেয়ে বড় মন্দায় পড়েছে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি। দেশটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ২০ দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে অর্থনীতি। দোকান বন্ধ থাকায় গৃহস্থালি ব্যয় হ্রাস পেয়েছে, কারখানা ও নির্মাণকাজও কমে গেছে, যা যুক্তরাজ্যকে ২০০৯ সালের পর প্রথম কৌশলগত মন্দার দিকে ঠেলে দিয়েছে। কৌশলগত মন্দার অর্থ হচ্ছে, পরপর দুই প্রান্তিকে অর্থনৈতিক সংকোচন।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে মন্দার সূচনা ফেব্রুয়ারি থেকে। প্রথম প্রান্তিকে মার্কিন জিডিপির পতন হয় ৫ শতাংশ। এরপর দ্বিতীয় প্রান্তিকে পতন হয় ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ। সেই সঙ্গে এখনো মার্কিন বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ২ শতাংশ, যা মহামন্দা-পরবর্তী যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

করোনার কারণে অর্থনৈতিক দুর্দশা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে জাপানে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে গত বছরের তুলনায় বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ এই অর্থনীতির মোট দেশজ উৎপাদন কমেছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থনৈতিক এই দুর্দশার অন্যতম কারণ হলো ভোক্তা ব্যয় ব্যাপক কমে যাওয়া। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য মহামারির কবলে পড়ায় দেশটির রপ্তানিও অত্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। টানা তিন প্রান্তিকে সংকোচন হয়েছে অর্থনীতিটির, যা কিনা ১৯৫৫ সালের পর থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থান।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে মন্দার সূচনা ফেব্রুয়ারি থেকে। প্রথম প্রান্তিকে মার্কিন জিডিপির পতন হয় ৫ শতাংশ। এরপর দ্বিতীয় প্রান্তিকে পতন হয় ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ। সেই সঙ্গে এখনো মার্কিন বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ২ শতাংশ, যা মহামন্দা-পরবর্তী যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। পাশাপাশি দেশটির বিপর্যস্ত দৈনন্দিন জীবন কবে স্বাভাবিক হবে, তা বলা যাচ্ছে না।

করোনার কারণে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ সবশেষ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, যেমনটি ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়েও খারাপ অবস্থায় যাচ্ছে এই ব্লকের অর্থনৈতিক অবস্থা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে ফ্রান্সের জিডিপি কমেছে ১৩ দশমিক ৮, ইতালির ১২ দশমিক ৪ এবং জার্মানির ১০ দশমিক ১ শতাংশ।

ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের মন্দার ইতিহাস

বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা হয়েছিল ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত, যাকে মহামন্দা বলে। এ ছাড়া তেলের দাম নিয়ে সৃষ্ট মন্দা, এশিয়ার ঋণসংকট বিশ্ব অর্থনীতিতে তীব্র প্রভাব ফেলে।

১৭৭২ সালের ঋণসংকট: ১৭৭২ সালের সংকটটির শুরু লন্ডনে। পরে তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপে। ব্রিটানিকা ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, ১৭৬০-এর দশকের দিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে সম্পদ সংগ্রহ করে, যা ব্রিটিশ ব্যাংকগুলোর মধ্যে অতি–আত্মবিশ্বাস এবং দ্রুত প্রসারণের একটি প্রবণতা তৈরি করে। তবে এর ঢেউটি ১৭৭২ সালের ৮ জুন হঠাৎ শেষ হয়ে যায়। ওই দিন ব্রিটিশ ব্যাংকিং হাউস নিল, জেমস, ফোর্ডিস ও ডাউনের অন্যতম অংশীদার আলেক্সান্ডার ফোর্ডিস তাঁর বিশাল ঋণ পরিশোধের দায় থেকে বাঁচতে ফ্রান্সে পালিয়ে যান। এই সংবাদ বন্দুকের গুলির মতো পুরো ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাংকিং খাতে তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আমানতকারীরা তাৎক্ষণিক নগদ টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ব্রিটিশ ব্যাংকগুলোর সামনে দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। পরে এই সংকট স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের বিভিন্ন অংশ এবং ব্রিটিশ-আমেরিকান উপনিবেশগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

১৯২৯-৩৯ সালের মহামন্দা: বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ছিল এই মহামন্দা। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদেরা ১৯২৯ সালের ২৯ আগস্ট ‘কালো মঙ্গলবার’ নামে অভিহিত করেন। ওই দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারের হঠাৎ দরপতনকে মহামন্দার সূত্রপাত বলে মনে করা হয়। অবশ্য অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ওই দরপতন ছিল মহামন্দার উপসর্গ, কারণ নয়। উপসর্গ বলা হচ্ছে এ কারণে যে ওই দরপতনের পর যুক্তরাষ্ট্র নানা দুর্বল নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়, যার কারণে মন্দায় পড়ে অর্থনীতি। বহু বছর ধরে ভুগতে হয়েছিল লাখো মানুষকে।

১৯৭৩ সালে তেলের দামের কারণে সৃষ্ট সংকট: ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সমর্থনে ছিল। একসময় বিমানযোগে অস্ত্র পাঠাতে শুরু করল তারা। সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো পাল্টা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল তেলকে। তারা তেলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়, যার কারণে হু হু করে বেড়ে যায় তেলের দাম। ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তাদানকারী সব দেশে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়। সারা বিশ্বে তৈরি হয় তেল সংকট। কোনো কোনো দেশে তো তেলের দাম ৪০০ গুণের বেশি বেড়ে গেল। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য অনেক উন্নত দেশে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অর্থনৈতিক স্থবিরতার তৈরি হয়। এই সংকটের পর উৎপাদন পুনরুদ্ধার করতে এবং মুদ্রাস্ফীতিকে তার সংকটকালের আগের পর্যায়ে নিয়ে যেতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যায়।

১৯৯৭-এর এশিয়ান সংকট: ১৯৯৭ সালে থাইল্যান্ড থেকে সৃষ্টি হয় এই সংকটের। দ্রুত পূর্ব এশিয়া এবং এর ব্যবসায়িক অংশীদার দেশগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়ে। সংকটের আগে ‘এশিয়ান টাইগার’ নামে পরিচিত পূর্ব এশীয় দেশ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক অঞ্চলে বহিরাগত মূলধন প্রবাহের সৃষ্টি হয়। এর ফলে এই দেশগুলোতে বিদেশি ঋণ অতিমাত্রায় বাড়তে থাকে। অর্থনীতিতে কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে আসতে থাকে। বিদেশি মুদ্রার অভাবে ১৯৯৭ সালের ২ জুলাই থাই সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে দীর্ঘদিন ধরে থাকা তার স্থিত বিনিময় হারের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়, যা এশিয়ার আর্থিক বাজারে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। কোটি কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আবার দেশ থেকে বের হয়ে যায়। এতে তীব্র যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়।

২০০৭-০৮-এর আর্থিক সংকট: ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রধান কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গৃহায়ণ খাতের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। দেশটির বন্ধকি বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণব্যবস্থা ও আর্থিক খাতের শিথিল নিয়ন্ত্রণই মন্দার শুরুটা করেছিল। ২০১১ সাল নাগাদ সংকট কাটিয়ে উঠেছিল বিশ্ব।