যুগে যুগে টিকা, টিকার যে অর্থনীতি
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছিল টিকা। ১৭৯৬ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার আবিষ্কার করেন বসন্তের টিকা। ইংরেজ জীবাণু গবেষক এই এডওয়ার্ড অ্যান্টনি জেনারকে বলা হয় প্রতিষেধকবিদ্যার জনক। সে সময় বসন্ত ছিল এক মারাত্মক আতঙ্কের নাম। এই রোগের ভাইরাসের নাম ভেরিওলা মেজর। এটি একবার সংক্রমিত হলে উজাড় হয়ে যেত লোকালয়। জেনারের টিকা সেই মহামারি নির্মূল করল। ১৯৭৭ সালে পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়ে গেছে কালান্তক গুটিবসন্ত।
গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার নানা জীবাণুঘটিত রোগের বিরুদ্ধে মানুষের সুস্থ থাকার লড়াইকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিল। এর মধ্যেই আবিষ্কৃত হয় আরও বহু রোগের প্রতিষেধক। প্রতিটি ইতিহাসই যেন একেকটি গল্পের মতো। ১৮৮৫ সালের ৬ জুলাই লুই পাস্তুরের গবেষণাগারে পাগলা (সংক্রমিত) কুকুরে কামড়ানো ৯ বছরের শিশুকে নিয়ে আসেন এক মা। সন্তানের প্রাণনাশের ভয়ে আতঙ্কিত ওই মায়ের মুখ দেখে অনেকটা বাধ্য হয়েই ওই শিশুর গায়ে নিজের উদ্ভাবিত প্রতিষেধক প্রবেশ করান লুই। পরবর্তী কয়েক দিনে নির্দিষ্ট মাত্রার প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করে বালকটিকে সুস্থ করে তোলেন তিনি। আবিষ্কার হয় জলাতঙ্কের কার্যকর প্রতিষেধক টিকা, মানুষের হাতে পরাভূত হয় আরেকটি অতি ভয়ংকর ভাইরাসঘটিত রোগ।
এমন সব অসাধারণ ইতিহাস রয়েছে টিকা নিয়ে। সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় জানা যায়, ১৯৫৩ সালে জোনাস সাল্কের পোলিও ভাইরাসের নিরাপদ ও কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার প্রাণঘাতী রোগটি থেকে মানুষকে বিভীষিকামুক্ত করেছিল। মূলত বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফলে টিকা উদ্ভাবনের একরকম বিস্ফোরণ ঘটে। হুপিং কাশি (১৯১৪), ডিফথেরিয়া (১৯২৬), টিটেনাস (১৯৩৮), ইনফ্লুয়েঞ্জা (১৯৪৪) ও মামসের (১৯৪৮) বিভীষিকা থেকে রক্ষা পায় মানুষ। আর এখন বর্তমান বিশ্ব চেয়ে রয়েছে আরেকটি টিকার আশায়। এবারের ভাইরাস করোনা, যেটির কারণে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
টিকার অর্থনৈতিক প্রভাব
টিকার অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করতে গেলে বেশ কিছু বিষয়ই উঠে আসে। বিশ্বের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, যেকোনো জনস্বাস্থ্য হস্তক্ষেপের তুলনায় সবচেয়ে কার্যকরী হলো ভ্যাকসিন বা টিকা। সর্বস্তরের জনগণের জীবন রক্ষা, সেই সঙ্গে সাশ্রয়ী চিকিৎসা সরবরাহ হলো এটি। একটি টিকা কর্মসূচির সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষ ব্যয় রয়েছে। ভ্যাকসিন ক্রয়, কর্মসূচিটি পরিচালনার জন্য অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যসেবা/প্রশাসনের কর্মীদের দ্বারা স্থিতিশীল সরবরাহব্যবস্থা বজায় রাখতে ভালো অঙ্কের ব্যয়ই করতে হয় একটি সরকারকে। সরকার কখনো কখনো দাতব্য সংস্থা ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমর্থন পায়। যারা স্বাস্থ্যের উন্নতির অভিপ্রায়ে এই বিনিয়োগ করে। আসলে একটি সফল ভ্যাকসিন কর্মসূচির মাধ্যমে রোগ নিরাময় হয়, মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসে, সেই সঙ্গে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় হ্রাস পায়, যা অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধির দিকেই ধাবিত করে। বিষয়টি একদম সরল অঙ্ক। সুস্থ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার ব্যয় কম হয়, রোগ বোঝার জন্য পরীক্ষা–নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে কম, সেই সঙ্গে ওই জনগোষ্ঠী কাজেও সময় দেয় বেশি, যা প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করে। আবার ডিটিএপি বুস্টার, আইপিভি ১, হিব বুস্টার, হেপাটাইটিস বি কোনো বাড়তি অবকাঠামোর খরচ ছাড়াই আরও কিছু রোগ থেকে রক্ষা করে।
টিকা কর্মসূচির ব্যয়-কার্যকারিতা বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে বিনিয়োগ বেশি হলেও তা মূল্যবান। বেশির ভাগ কর্মসূচিতে প্রতিটি জীবন বাঁচাতে ব্যয় হয় ৫০ ডলারের কম। গ্যাভি ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স জানায়, এই বিনিয়োগে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ নিট লাভ হয়। বসন্ত ও পোলিও রোগ নির্মূলের অর্থনৈতিক ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। এতে দেখা যায়, বসন্ত নির্মূলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যদি ১০ কোটি ডলার বেশি ব্যয় হয়, তাহলে দেশটির বার্ষিক সাশ্রয় হয় ১৩৫ কোটি ডলার। অন্যদিকে পোলিওর ক্ষেত্রে এই সাশ্রয় প্রায় ১৫০ কোটি ডলার।
স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা একে অপরের পরিপূরক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেশি করা সম্ভব হয়, আবার স্বাস্থ্যবান জনসংখ্যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে।
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক টিকাদান কর্মসূচির অগ্রগতি কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় ৩ কোটি শিশুর মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়া হয়নি। আসলে অনেককেই টিকা দেওয়া হয়নি। সমস্যাটি যা ছিল, তা হলো—নতুন ভ্যাকসিনগুলো সহজলভ্য হলেও তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামর্থ্যের মধ্যে ছিল না। এ অবস্থা অনুধাবন করে বিশ্বের সে সময়ের শীর্ষ ধনী বিল গেটস ও তাঁর স্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও এর অংশীদারেরা ২০০০ সালে ভ্যাকসিন ও সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করতে গ্যাভি ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গঠন করে। এই সংগঠনের লক্ষ্য হলো, নিম্ন আয়ের দেশ, যাদের সামর্থ্য নেই, সেসব দেশের জন্য টিকার দাম কমিয়ে আনতে উৎপাদনকারীদের উৎসাহিত করা। এটি কাজ শুরু করার পর ব্যাপকভাবে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল।
আসলে টিকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রভাব হলো উৎপাদনশীলতার প্রভাব।
স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা একে অপরের পরিপূরক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেশি করা সম্ভব হয়, আবার স্বাস্থ্যবান জনসংখ্যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে। তাই স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ জল, অ্যান্টিবায়োটিকসহ টিকা ও অন্যান্য জনস্বাস্থ্য হস্তক্ষেপ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্তবয়স্ক অসুস্থ জনগোষ্ঠী একটি দেশের উৎপাদন কমিয়ে ফেলে। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে টিকার ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য।
করোনার ভ্যাকসিনের অর্থনীতি
সারা বিশ্বের মানুষ এখন চেয়ে আছে একটি টিকার জন্য। গত ৯ মাসে বিশ্বকে রীতিমতো ওলটপালট করে দিয়েছে করোনা নামের ভাইরাস। জীবন ও জীবিকা দুটির জন্যই এখন বড় প্রশ্ন হলো, কবে আসছে টিকা। কারা প্রথমে তৈরি করছে করোনার টিকা। সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হলো, টিকা এল কিন্তু কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা যদি এতে হস্তক্ষেপ না করে তবে কি এটি সর্বস্তরে পৌঁছাবে। উত্তর যে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশটি সবার পরেই এই টিকা পাবে।
যেমন এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশ টিকা পাওয়ার জন্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করলেও বেশির ভাগ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশই এই আলোচনায় নেই। এমনকি যারা চুক্তির জন্য আলোচনা করেছে, তারা যে এটি তৈরি হলেই পাবে, এমন গ্যারান্টি নেই। আবার যতটা পাবে, তা কতটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করা সম্ভব হবে, তা–ও এখনো অজানা। সরকারগুলো ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে আংশিক বা পুরোপুরি ভর্তুকি না দিলে, তা দরিদ্রদের জন্য অযোগ্য থাকবে—এমনটা বলাই যায়। কিছু দেশ নিখরচায় ভ্যাকসিন সরবরাহ করার পরিকল্পনাও করছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভ্যাকসিনের কারণে দরিদ্র দেশে করোনা থেকে গেলে, তা থেকে রেহাই মিলবে না কোনো দেশেরই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেন, ‘আমাদের ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ রোধ করতে হবে।’
টিকা কেবল দামের যুদ্ধে জয়ী হওয়া ধনী দেশগুলোর কাছে যাওয়া উচিত নয়। টিকা সরবরাহে অব্যবস্থাপনা হলে আরও অনেক মৃত্যু হতে পারে।’
প্রাণঘাতী এই ভয়াবহ ভাইরাস মোকাবিলা করতে বিশ্বব্যাপী ২৪০টি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজ বর্তমানে চলছে। এর মধ্যে ৪০টি ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে, অর্থাৎ সীমিত পর্যায়ে মানুষের ওপর পরীক্ষা চলছে। নয়টি ভ্যাকসিন পরীক্ষার কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, যেগুলো কয়েক হাজার মানুষের শরীরে পরীক্ষার কাজ বর্তমানে চলছে। আসলে কোনো একটি ভ্যাকসিন তৈরি করতে সময় লাগে সাধারণত কয়েক বছর, কিন্তু বিশ্বব্যাপী এই জরুরি অবস্থা মোকাবিলার তাগিদে বিজ্ঞানীরা দ্রুততম সময়ে টিকা তৈরির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত আগস্টের শুরুতে জানা যায়, ভ্যাকসিন এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তারপরও ধনী দেশগুলো করোনাভাইরাসের ২০০ কোটি ডোজ কেনার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এমনটা হলে ভ্যাকসিন সরবরাহ মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে যেতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মহামারি থেকে মুক্তি মিলবে না, যদি সব জায়গা থেকে এটি দূর করা না যায়। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বিল গেটস বলেন, ‘টিকা কেবল দামের যুদ্ধে জয়ী হওয়া ধনী দেশগুলোর কাছে যাওয়া উচিত নয়। টিকা সরবরাহে অব্যবস্থাপনা হলে আরও অনেক মৃত্যু হতে পারে।’
দাতব্য সংস্থা অক্সফামের কিছুদিন আগে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিকা এখনো আসেনি অথচ এখনই ধনী দেশগুলো সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের উৎপাদনসক্ষমতার ৫১ শতাংশই কিনে ফেলেছে। কিন্তু ওই দেশগুলোতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষের বসবাস। ধনী দেশের এই কাড়াকাড়ির কারণে আবিষ্কারে এগিয়ে থাকা ৫টি ভ্যাকসিনও যদি সফল হয়, তবু ২০২২ সালের আগে বিশ্বের দুই–তৃতীয়াংশ বা ৬১ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নিতে পারবে না বলে সতর্ক করেছে অক্সফাম।
আসলে যত যা–ই বলা হোক না কেন, ৮০০ কোটি মানুষের এই বিশ্বে সবার জন্য টিকা তৈরি করে তা সরবরাহ করতে বছরের পর বছর লেগে যাবে। তা–ও সেটি নির্ভর করছে কৌশলগত ব্যবস্থাপনার ওপর। এ লক্ষ্যে জুনে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন ও সুষ্ঠু ন্যায়সংগত বিতরণের লক্ষ্যে গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্রুপ (গ্যাভি) এবং কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপিয়ার্ডনেস ইনোভেশনসের (সিইপিআই) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি কৌশল প্রণয়ন করেছে ডব্লিউএইচও। আর উদ্যোগটির নাম ‘কোভ্যাক্স’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত ১৫৬টি দেশ কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিতে ভ্যাকসিন সহযোগিতায় অংশীদার হয়েছে। এর মধ্যে ৬৮টি উচ্চ আয়ের দেশ ও ৯২টি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশ রয়েছে। ভ্যাকসিনের ন্যায়সংগত বণ্টনের ক্ষেত্রে একমাত্র বৈশ্বিক উদ্যোগ এটি। তবে তারপরও বলা যায়, এই মুহূর্তে এটিই সবচেয়ে ভালো উদ্যোগ।
এখন সময় কেবল অপেক্ষার।