রহস্যময় রথসচাইল্ড পরিবার

বিশ্বের ব্যাংকিং ইতিহাসের অন্যতম নাম রথসচাইল্ড পরিবার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অর্থের সমার্থক শব্দই যেন ছিল এই পরিবার। তবে সব সময় গোপনীয়তা রক্ষা করা এই ব্যাংকিং খাতের রাজবংশের ইতিহাসে প্রচলিত আছে বহু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য পরিবার হওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে রহস্যময় পরিবারের খেতাবও জুটেছে তাদের।

প্রায় ২০০ বছর আগে ইউরোপের অর্থনৈতিক ইতিহাসই পাল্টে ফেলেছিল এই পরিবার। প্রথমে এই সাম্রাজ্যের সূচনা করেন মায়ার আমসেল রথসচাইল্ড। এরপরে কান্ডারি হন তাঁর ছেলেরা। রথসচাইল্ড ফ্যামিলি ছিল বিশ্বের একমাত্র ট্রিলিয়নিয়ার ফ্যামিলি। এই পরিবারের প্রত্যেকেই ছিলেন একেকজন বিলিয়নিয়ার। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত রথসচাইল্ড অ্যান্ড কোম্পানি একটি বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক এবং আর্থিক পরিষেবা সংস্থা।
মায়ার আমসেল রথসচাইল্ডের জন্ম ১৭৪৪ সালে জার্মানির জুডেনগাসে এক ইহুদি পরিবারে। সে সময় জার্মানিতে ইহুদিদের চলাচলে অনেক বাধানিষেধ ছিল। মায়ার রথসচাইল্ডের বাবা ছিলেন পেশায় একজন মহাজন ও সিল্কের ব্যবসায়ী।

রথসচাইল্ডের যখন ১২ বছর বয়স, তখন গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মা-বাবা মারা যান। এরপর তিনি হ্যানোভারে চলে আসেন, একটি ব্যাংকে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি বিদেশি বাণিজ্য সম্পর্কে শেখেন। এ ছাড়া প্রাচীন রোম, পার্সিয়া এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরল মুদ্রা জোগাড় করতেন মায়ার। ১৭৬৩ সালে ১৯ বছর বয়সে ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরে এসে বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসায় যোগ দেন রথসচাইল্ড। একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সঙ্গে বিরল মুদ্রার ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এ ব্যবসার সূত্র ধরেই হেসের ক্রাউন প্রিন্স উইলহেমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। তা ছাড়া আগে থেকেই প্রিন্স উইলহেম তাঁর বাবার থেকে কয়েন কিনতেন। প্রিন্সের ঘনিষ্ঠজন হয়ে নানা ধরনের সুবিধা ও অন্য অভিজাতদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন তিনি।

ক্রাউন প্রিন্স উইলহেম ছিলেন প্রচুর সম্পদের উত্তরাধিকারী। পরবর্তীকালে রাজা হন তিনি। ১৭৬৯ সালে রাজা উইলহেমের কাছে ক্রাউন এজেন্ট উপাধি নেন রথসচাইল্ড। ভালো বংশে বিয়ে করেন। তাঁর ছিল পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। পরবর্তীকালে তাঁর পাঁচ ছেলে আমসেল, সালমন, নাথন, কার্ল ও জ্যাকবকে নিয়েই ব্যাংকিং সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।

ফরাসি বিপ্লবের সময় মায়ারের ব্যাংকিং ব্যবসা ফুলে–ফেঁপে ওঠে। সে সময় মার্চেন্ট ব্যাংক খোলার জন্য এক ছেলেকে ফ্রাঙ্কফুর্টে রেখে বাকি চারজনকে পাঠিয়ে দেন ইউরোপের চার সমৃদ্ধ শহর নেপলস, প্যারিস, ভিয়েনা ও লন্ডনে। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে তাঁদের এই পরিবার ছিল ইউরোপের সবচেয়ে ধনী পরিবার। ১৮১২ সালে মারা যান মায়ার রথসচাইল্ড। মারা যাওয়ার আগে উত্তরাধিকারীদের ব্যবসা পরিচালনার বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়ে যান তিনি। উইল করে বলে যান, বাইরের কেউ পরিবারের ব্যবসায় ঢুকতে পারবে না এবং পরিবারের বড় ছেলেই থাকবেন প্রধান হিসেবে।

রথসচাইল্ড পরিবারের সদস্যরা সব সময় নিজেদের কাজের বিষয়ে ব্যাপক গোপনীয়তা রক্ষা করতেন। সে সময় খ্রিষ্টানরা অর্থঋণ নিতে না পারায়, অনেক অভিজাত তাঁদের আর্থিক লেনদেন পরিচালনার জন্য ইহুদির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। স্পষ্টতই, মায়ার বিনিয়োগে খুব ভালো ছিলেন এবং তাই শাসক পরিবারগুলোও তাঁর শরণাপন্ন হতে শুরু করে।

যে ষড়যন্ত্রের হোতা রথসচাইল্ডরা

রথসচাইল্ড পরিবারের সদস্যরা সব সময় নিজেদের কাজের বিষয়ে ব্যাপক গোপনীয়তা রক্ষা করতেন। সে সময় খ্রিষ্টানরা অর্থঋণ নিতে না পারায়, অনেক অভিজাত তাঁদের আর্থিক লেনদেন পরিচালনার জন্য ইহুদির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। স্পষ্টতই, মায়ার বিনিয়োগে খুব ভালো ছিলেন এবং তাই শাসক পরিবারগুলোও তাঁর শরণাপন্ন হতে শুরু করে। যাহোক, একসময় রাজনৈতিক কারণে উইলহেমকে ডেনমার্কে পালিয়ে যেতে হয়। প্রচলিত আছে, পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনি রথসচাইল্ডকে ৬০ হাজার পাউন্ড দিয়ে যান।

রথসচাইল্ডের সবচেয়ে চতুর ছেলে নাথান

প্রচলিত আছে, বুদ্ধিমান মায়ার রথসচাইল্ড ওই ৬০ হাজার পাউন্ড দিয়ে তাঁর চার ছেলেকে ইউরোপের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে পাঠিয়ে দেন মার্চেন্ট ব্যাংক খুলতে। এভাবে শুরু হয় রথসচাইল্ড পরিবারের পুরো ইউরোপের ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। পাঁচটি শহরের রাজপরিবারের সঙ্গে রথসচাইল্ড পরিবারের ব্যবসা ছিল।
ইনভেস্টপেডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, নাথান ছিল মায়ার রথসচাইল্ডের চতুর্থ ছেলে। তাঁকে পাঠানো হয়েছিল লন্ডনে। প্রথমে সেখানে তিনি টেক্সটাইল ব্যবসা শুরু করেন। কয়েক বছর পর লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার কেনাবেচা শুরু করেন। এর মধ্যে এন এম রথসচাইল্ড অ্যান্ড সনস লিমিটেড নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যাংকের মাধ্যমে সে সময় যুদ্ধে সরকারকে অর্থায়ন করা হতো। ১৮১১ সালে নেপোলিয়নের সঙ্গে যখন ইংল্যান্ডের যুদ্ধ হয়, দারুণ চতুরতার পরিচয় দেন নাথান। তিনি ইংরেজ সরকারকে অর্থায়ন করতেন, গোপনে নেপোলিয়নকেও দিতেন। অর্থাৎ দুই দলকেই হাতে রাখতেন।

যাহোক, ওয়াটার লু যুদ্ধে ইংল্যান্ডের রাজার কাছে খবর আসে, নেপোলিয়ন হারছেন, তবে তা বিশ্বাস করেননি রাজা। তবে এই খবর কাজে লাগান নাথান। তিনি গুজব ছড়ান ইংল্যান্ডের অবস্থা খারাপ, খুব শিগগির সরকারের বন্ড মূল্যহীন হয়ে যাবে। সবাই হুড়মুড় করে বন্ড বিক্রি শুরু করে। একদিনে ধসে পড়ে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ। নাথান নিজের এজেন্ট নিয়োগ করে সেই বন্ড কম দামে সংগ্রহ করে নেন। যুদ্ধে জিতেছে ইংল্যান্ড—এটা জানার আগেই ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয় নাথানের ব্যাংক। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই যুদ্ধে ধার করা অর্থ ২০০ বছর ধরে রথসচাইল্ড পরিবারকে পরিশোধ করেছে যুক্তরাজ্য সরকার।

এখন কেমন আছে রথসচাইল্ড পরিবার

যুদ্ধ, রাজনীতি এবং পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গত ১০০ বছরে কমিয়ে দিয়েছে রথসচাইল্ড পরিবারের জৌলুশ। নানা কারণে নেপলস, অস্ট্রিয়া ও ভিয়েনায় বন্ধ হয়ে যায় ব্যাংকের শাখা। বর্তমানে এই পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি ডলার। মজার বিষয় হচ্ছে, মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস–এর সম্পদশালীর তালিকায় বিশ্বের প্রথম ৫০০ ধনী ব্যক্তির মধ্যে ‘রথসচাইল্ড’ নামের একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, অনেক বছর ধরেই রথসচাইল্ডের সম্পদ তার কয়েক শ উত্তরাধিকারীর মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে।