রাজ্য হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল যে বিমান সংস্থা

এ বিশ্ব যেন উত্থান-পতনের খেলা। কখনো রাজরাজাদের পতন হয়, রাজ্য পট পাল্টায়, কখনো–বা উত্থান হয় নতুন সরকারব্যবস্থার। সাফল্যের চূড়ায় ওঠা কোম্পানিও কয়েক দশকের মধ্যে হয়ে পড়ে দেউলিয়া। এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে বিশ্বের ইতিহাসে। আজ বলব তেমনি এক কোম্পানির উত্থান থেকে পতনের গল্প।

সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় এয়ারলাইনস ছিল প্যান অ্যাম। ভাবা যায়, ১৯৭০ সালে এক বছরে বিশ্বের ৮৬টি দেশে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছিল ওই বিমান সংস্থা। আধুনিক বিমান চলাচলব্যবস্থার পথিকৃৎ বলা হয় এই এয়ারওয়েজকে। মূলত প্যান আমেরিকান এয়ারওয়েজ ‘প্যান আম’ নামে পরিচিত ছিল। তবে প্রতিষ্ঠার ৬০ বছরের মধ্যে বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়ে শেষ হয়ে যায় প্যান অ্যাম।

মার্কিন এয়ারফোর্সের দুই মেজর ১৯২৭ সালে প্যান অ্যাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথমে ফ্লোরিডা, কিউবা ও হাভানার মধ্যে এয়ার মেইল পরিষেবা চালুর মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে প্যান অ্যাম। এক বছরের মধ্যে এভিয়েশন কোম্পানি জুয়ান ট্রিপি প্যান অ্যামের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপরই প্রথম যাত্রীবাহী পরিষেবা চালু করে সংস্থাটি, গন্তব্য ছিল হাভানা। এমনকি কিছুদিনের মধ্যে সি প্লেনও যুক্ত হয় প্যান অ্যামের বহরে। এরপর বহুদিন কেবল উত্থানেরই গল্প।

১৯৫৮ সালের মধ্যে প্যান অ্যাম অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সব কটি মহাদেশে নিয়মিত বিমান পরিবহন করা শুরু করে। প্রতিষ্ঠার ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে অভিজ্ঞ বিমান সংস্থার উপাধিটা চলে যায় প্যান অ্যামের হাতে। প্যান অ্যামের আধুনিক বিমানগুলো খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও সহজে উড়তে পারত। যাত্রীরা ভেতরে বসে বাইরে আবহাওয়া বুঝতেই পারত না। এর দৃষ্টিনন্দন কেবিনগুলোয় সে সময়ই বহুভাষিক, কলেজ-শিক্ষিত বিমানের ক্রু ছিল। সে সময়ই স্টেক, ক্যাভিয়ারের মতো বিলাসবহুল খাবার পরিবেশন করা হতো প্যান অ্যামের ফ্লাইটে।

১৯৫৮ সালের ২৬ অক্টোবর প্রথম জেট এয়ারক্রাফট উড্ডয়ন করে প্যান অ্যাম। এয়ারলাইনসটির বোয়িং ৭০৭ ফ্লাইট ওই দিন নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসে আট ঘণ্টার উড্ডয়ন করে। এর মাধ্যমে জেট যুগে প্রবেশ করে বিশ্ব। শক্তিশালী নতুন জেট ইঞ্জিনগুলো অনেক দূরের পথ একনাগাড়ে যেতে পারত। এ কারণে খুব তাড়াতাড়ি লন্ডন এবং প্যারিসে দৈনন্দিন বিমান পরিবহনের অনুমতি মিলে যায় প্যান অ্যামের। মজার তথ্য হলো, প্রথম ইকোনমি ক্লাসের প্রবর্তন করেছিল প্যান অ্যাম। আর এর মাধ্যমে কেবল ধনী এবং বিখ্যাত ব্যক্তিরা নন, পর্যটকদের জন্য বিমানভ্রমণের জগৎ উন্মুক্ত হয়ে যায়। ১৯৭০ সালে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ প্যান অ্যামে ভ্রমণ করেছিল। বিমানভ্রমণ সেবা আরও বাড়াতে বোয়িং ৭৮৭ জেটলাইনারের একটি বড় বহরে অর্ধ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে প্যান অ্যাম। আর প্যান অ্যামের ভুলের শুরুটা এখান থেকেই।

তেল সংকটে প্যান অ্যামের প্রথম ধাক্কা

১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সমর্থনে ছিল। একসময় বিমানযোগে অস্ত্র পাঠাতে শুরু করল তারা। সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো পাল্টা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল তেলকে। তারা তেলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়, যার কারণে হু হু করে বেড়ে যায় তেলের দাম। ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দানকারী সব দেশে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়। সারা বিশ্বে তৈরি হয় তেলের সংকট। কোনো কোনো দেশে তো তেলের দাম ৪০০ গুণের বেশি বেড়ে গেল।

এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য অনেক উন্নত দেশে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অর্থনৈতিক স্থবিরতা তৈরি হয়। এটি অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় প্যান অ্যামকে শক্তভাবে আঘাত করে। কারণ, সে সময় একচেটিয়াভাবে দীর্ঘ দূরত্বের ফ্লাইট কেবল প্যান অ্যামেই চালু ছিল। প্রচুর জ্বালানির প্রয়োজন হতো কোম্পানিটির। বোয়িং ৭৮৭ দুর্দান্ত একটি উড়োজাহাজ হলেও তেলের সংকট প্যান আমের জন্য পরিস্থিতি সত্যিই বদলে দিয়েছিল। এটি প্যান অ্যামের জন্য ভুল পছন্দ ছিল। জ্বালানির ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ভ্রমণের চাহিদা কমে যায়। প্যান অ্যামের পরিচালন ব্যয় যখন আকাশচুম্বী, তখন চলছে মার্কিন অর্থনীতির দুর্দশা। এমনও হয়েছে, অর্ধেক খালি উড়োজাহাজ নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়েছে প্যান অ্যামকে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে, প্যান অ্যামের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অনুমান করা হয়, এ সময় প্রায় ১০০ কোটি ডলার ঋণে জড়িয়ে পড়ে প্যান অ্যাম।

দ্বিতীয় যে ভুল

দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিমান সংস্থাগুলোকে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করার আশা ছিল প্যান অ্যামের। এ লক্ষ্যে আমেরিকান ও ইউনাইটেড এয়ারলাইনসসহ বেশ কয়েকটি দেশীয় অপারেটরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয় তারা। । তবে প্রতিদ্বন্দ্বী এয়ারলাইনসগুলো মার্কিন কংগ্রেসের কাছে প্যান অ্যামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। তারা বলতে চায়, একচেটিয়া ব্যবসা করার অবৈধ বাসনা রয়েছে প্যান অ্যামের, যা বিমান সংস্থাগুলোর জন্য হুমকি। ফলে বিমান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমতি মেলে না। তবে ১৯৭৮ সালে এয়ারলাইন ডিরেগুলেশন আইন পাস হয় যুক্তরাষ্ট্রে, যার অর্থ সরকার আর বিমান সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। প্যান অ্যাম অভ্যন্তরীণ বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনুমতি পায়। প্যান অ্যাম তাড়াতাড়ি ৪৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারে ন্যাশনাল বিমান সংস্থা কিনে নেয়। এটি বড় ভুল ছিল প্যান অ্যামের জন্য।

ন্যাশনাল এয়ারলাইনস কেনার এক বছরের মধ্যে ১ কোটি ৮৯ লাখ ডলার লোকসান হয় প্যান অ্যামের। এমনকি ম্যানহাটনে তাদের বিলাসবহুল অফিসটিও বিক্রি করে দিতে হয়। তারপরও লোকসান মেটানো সম্ভব হয় না। নানা পদক্ষেপ নিতে থাকে প্যান অ্যাম। এর হোটেল চেইনগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যভাবে ব্যবসা শুরু করে তারা। পাশাপাশি এটি তার পুরো প্যাসিফিক বিভাগ ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের কাছে বিক্রি করে দেয়। তবে প্যান অ্যামের কবরে শেষ পেরেক মেরেছিল স্কটল্যান্ডের লকারবিতে ঘটা সন্ত্রাসী হামলা।

লকারবির সেই দুর্ঘটনা

২১ ডিসেম্বর ১৯৮৮, কয়েক শ যাত্রী নিয়ে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে প্যান অ্যামের ফ্লাইট ১০৩ উড়েছিল। ভ্রমণকারীদের গন্তব্য ছিল নিউইয়র্ক সিটি। ফ্লাইটটি একটু দেরি হয়েছিল, সন্ধ্যার দিকে ছেড়েছিল। উড্ডয়নের আধা ঘণ্টার মধ্যে উড়োজাহাজে বোমা বিস্ফোরিত হয়, যা লকারবি বোমা হামলা নামে পরিচিত। ওই দুর্ঘটনায় ২৪৩ যাত্রী এবং ১৬ ক্রু মেম্বার নিহত হন। এমনকি বিমানটি মাটিতে আছড়ে পড়ায় নিহত হন ১১ জন। এই হামলার জন্য লিবিয়ার সাবেক নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র। লকারবি বোমা হামলার কারণে প্যান অ্যামের প্রায় সাড়ে তিন কোটি ডলারের ক্ষতি হয়। এর ঠিক দুই বছর পর, ১৯৯১ সালের ৮ জানুয়ারি দেউলিয়ার জন্য আবেদন করে প্যান অ্যাম।

প্যান অ্যামের আরও কিছু দুর্ঘটনা

লকারবির আগেও কয়েকটি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে প্যান অ্যাম। ১৯৮৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। ভারতের মুম্বাই থেকে প্যান অ্যামের একটি ফ্লাইটের গন্তব্য ছিল নিউইয়র্ক। মুম্বাই থেকে ছেড়ে আসার পর উড়োজাহাজটি পাকিস্তানের করাচি বিমানবন্দরে নামে। সে সময় ফিলিস্তিনি অস্ত্রধারীদের কবলে পড়ে উড়োজাহাজটি। উড়োজাহাজটি যখন টারমার্কে দাঁড়ানো অবস্থায় ছিল, সে সময় নিরাপত্তারক্ষীদের ছদ্মবেশ ধারণ করে অস্ত্রধারীরা ভেতরে ঢুকে পড়েন। ঢুকেই অস্ত্রধারীরা কেবিন ক্রুদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলেন, তাঁদের পাইলটের কাছ নিয়ে যেতে হবে। তখন কেবিন ক্রুদের মধ্যে একজন বেশ দ্রুততার সঙ্গে পাইলটদের জানিয়ে দেন যে বিমানে অস্ত্রধারীরা প্রবেশ করেছেন।

তখন পাইলটরা বিমান থেকে বেরিয়ে যান। ছিনতাইকারীরা পাইলটদের ফিরিয়ে আনার জন্য নানা ধরনের চাপ দিচ্ছিলেন। কারণ, তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বিমানটিকে ইসরায়েল অথবা সাইপ্রাসে নিয়ে যাওয়া। পাইলটরা বিমানে ফিরে না আসায় অস্ত্রধারীরা একজন যাত্রী গুলি করে হত্যা করে বিমান থেকে নিচে ফেলে দেন।

ছিনতাইকারীরা মার্কিন যাত্রীদের খুঁজছিলেন। ওই ঘটনায় ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হন ভারতীয় কেবিন ক্রু নিরজা। পরবর্তী সময়ে যাঁকে নিয়ে বলিউডে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। যখন সন্ধ্যা হয়, তখন বিমানের ভেতরও অন্ধকার নেমে আসে। তখন বিমানের তিনটি দরজা খুলে দেওয়া হয়। অন্ধকারের মধ্যে অস্ত্রধারীরা বিষয়টি বুঝতে পারেননি। সে সুযোগে অনেক যাত্রীকে নামিয়ে দেন কেবিন ক্রুরা। একপর্যায়ে অস্ত্রধারীরা বিমান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ওই ঘটনায় ২২ জন নিহত এবং ১৫০ জন আহত হন।

স্পেনের টেনেরিফে বিমানবন্দরে আরেকটি বড় দুর্ঘটনার মুখে পড়ে প্যান অ্যাম। ১৯৭৭ সালের ২৭ মার্চ স্পেনের লাস প্যামাস বিমানবন্দরে একটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় প্যান অ্যাম ও নেদারল্যান্ডসের কেএলএম এয়ারলাইনসের দুটি উড়োজাহাজকে স্পেনের আরেকটি বিমানবন্দর টেনেরিফে পাঠানো হয়। সেখানে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর দুটি বিমানকেই রানওয়েতে আপ ট্র্যাকের নির্দেশ দেওয়া হয়।

কেএলএম বিমানটি তার টেক-অফ পয়েন্টে পৌঁছায়, প্যান অ্যাম বিমানটি তখনো রানওয়েতেই ছিল। কারণ, প্যান অ্যাম বিমানটি রানওয়েতে তখন পর্যন্ত ট্যাক্সিওয়ের টিকিট পেয়েছিল। আবার রানওয়েতে সেদিন ছিল ভারী কুয়াশা। কেএলএম বিমানটি টেক অফ করতে শুরু করে। এটিসি কন্ট্রোলার এবং প্যান আম পাইলট দুই দলই কেএলএম বিমানকে সতর্কবার্তা প্রেরণ করেছিল। তবে দুজনের রেডিও ট্রান্সমিশন একযোগে হওয়ায় কেএলএম কারোটাই শুনতে পায়নি। কেএলএম বিমানটি টেক অফ করার সঙ্গে সঙ্গেই প্যান অ্যামের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে দুটি উড়োজাহাজেই আগুন ধরে বিস্ফোরিত হয়। কেএলএমের ২৩৪ যাত্রী ও ১৪ ক্রু এবং প্যান অ্যামের ৩২৬ যাত্রী ও ৯ ক্রুসহ মোট ৫৮৩ জন নিহত হন।