সংকটে নতুন চাকরি পেতে যে পরামর্শ

কাজ নেই, অফিস বন্ধ। আর এখন কোভিড-১৯–এর দ্বিতীয় ধাক্কার আশঙ্কাছবি: এএফপি

১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল তা কেবল যে মন্দার তীব্রতার জন্য তা নয়, এর সঙ্গে যুক্ত ছিল মন্দার সময়কালটাও। সময়ের বিষয়টি আনার কারণ হলো একই সময়ে দুটি অর্থনৈতিক সংকট দেখা গিয়েছিল সেই মন্দায়। প্রথমে একটা উৎপাদনের সংকট তৈরি হয়। এর অর্থ হলো পণ্য ও সেবার উৎপাদন কমে যায় এবং যার ফলে যে চাকরিগুলো বর্তমান ছিল তা কমে গেল। ফলে বেকারত্বের হার বেড়ে গেল হু হু করে। যার কারণে অর্থনীতিতে মানুষের ভোগ কমে গেল। বিষয়টা একটা সহজ সূত্র। চাকরি নেই, পকেটে টাকা নেই, তাই খরচ করাও নেই। আসলে মন্দার কথা তো আমরা বারবারই বলছি।

মন্দা আসলে কী? আভিধানিক অর্থে পরপর দুই প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত হলে কোনো দেশ মন্দায় পড়েছে বলে বলা যায়। মন্দা তখনই আসে যখন অর্থনীতি তার সক্ষমতার চেয়ে উল্লেখযোগ্য কম কাজ পরিচালনা করে। একটি দেশের অর্থনীতিতে বেকারত্ব, মুদ্রা সংকোচন ও উৎপাদন ঘাটতি দেখা দেওয়াকে অর্থনৈতিক মন্দা বলে। মন্দার সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার ১৫ শতাংশের ওপরে থাকে। অর্থাৎ অর্থনীতি তার সক্ষম কর্মী বাহিনী কাজে লাগাতে পারে না। যেমনটা দেখা গিয়েছিল ১৯৩০–এর দশকের মহামন্দার সময়ও। ওই সময় যুক্তরাজ্যের বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছিল। ২০০৮ ও ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকটেও দেখা গিয়েছিল, বেকারত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং জিডিপি সংকুচিত হয়।

সমস্যা কর্মসংস্থানের

এবারের নতুন সংকট করোনা। এই সংকটে জীবন ও জীবিকার অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। ১০ মাসের বেশি সময় ধরে চলা এই করোনাযুদ্ধে বিশ্বে কোটির বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, করোনার প্রভাবে পৃথিবীতে কয়েক কোটি মানুষ চাকরি হারাবেন। একেবারে হারিয়ে যাবে অনেক কাজ। পৃথিবীতে সব দেশে একযোগে চলছে ছাঁটাই, বরখাস্ত, চাকরিচ্যুতি। কান্ট্রিইকোনমি ডট কমের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হার ৮ দশমিক ৮ শতাংশ, ইউরোজোনের ৮ দশমিক ১ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের সাড়ে ৪ শতাংশ। ইউরোজোনের মধ্যে আবার গ্রিসে এ হার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, স্পেনে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে ব্রাজিলে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় এই হার ২৩ শতাংশের ওপরে।

আসলে করোনাভাইরাস শুধু জীবন ও স্বাস্থ্যেই প্রভাব ফেলছে না, এই ভাইরাস সংক্রমণের প্রভাব পড়েছে সব ধরনের অর্থনীতিতেও। যার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য নিম্নমুখী হওয়াতে কর্মীরা চাকরি হারানোর আতঙ্কে ভুগছেন। যে চাকরি রয়ে গেছে, সেখানেও সৃষ্টি হয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। আছে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার পরীক্ষা। কীভাবে নতুন চাকরি পাবেন? একজন আবেদনকারী হিসেবে কীভাবে দাঁড়াবেন? এমন সব প্রশ্নই এখন মুখ্য। গণমাধ্যম বিবিসি যুক্তরাজ্যের বেশ কয়েকজন প্রধান নির্বাহীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন বর্তমান এই সময়ের একজন চাকরিপ্রার্থী নিজের মধ্যে কোন গুণের উন্নয়ন করবেন। নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকেই সেই পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

চাকরির ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন প্রধান নির্বাহীরা

প্রধান নির্বাহীদের পরামর্শ

অনলাইন মার্কেটপ্লেস নট অন দ্য হাই স্ট্রিটের প্রতিষ্ঠাতা হোলি টাকার জানান, আবেদনকারীর সৃজনশীলতা কতটুকু এটিই তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রাধান্য পায়। তিনি বলেন, ‘যে কাজের জন্যই হোক না কেন প্রার্থীর সৃজনশীলতা দেখতে চাই। তার আবেদনপত্রে যেন থাকে যত্ন, মনোযোগ, বিস্তারিত তথ্য এবং সৃজনশীলতা।’ এমনকি পছন্দের আবেদন চিঠি তিনি যত্ন করে রেখে দেন বলেও জানান।

যুক্তরাজ্যের অন্যতম খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘আন সামারসের’ প্রতিষ্ঠাতা জ্যাকুলাইন গোল্ড বলেন, ‘যে সেক্টরে আপনি কাজ করেন, সময়-সময় ওই সংশ্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা উচিত। এ রকমটা বলার কারণ হলো জ্যাকুলাইন যখনই কাউকে চাকরিতে নিয়োগ দিতে চান, তখনই তিনি খোঁজ নেন ওই ব্যক্তিকে কেউ চেনেন কি না। তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। তাই চাকরির ক্ষেত্রে একটি পরিচিত মহল তৈরি করে নেওয়া উচিত। একজন যদি তাঁর বর্তমান বা পূর্ববর্তী চাকরিতে প্রশংসিত মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারেন, যখন তাঁরা অন্য কোথাও যাবেন, সেখানে নতুন মানুষ লাগলে তাঁরা তাঁর নাম পরামর্শ দেবেন। জ্যাকুলাইন বলেন, ভালো মানুষই ভালো মানুষ খুঁজে নেন।

রবার্ট ওয়ালটার নিজের প্রচেষ্টাতেই যুক্তরাজ্যে একটা নিয়োগ সংস্থা খুলেছিলেন। বেশ সফল তাঁর এই ব্যবসা। তিনি বলেন, চাকরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আত্মবিশ্বাস। এমনকি এই ডিজিটাল বিশ্বেও মুখোমুখি যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ। যে চাকরি পেতে চান তার জন্য নিজেকে দক্ষ করে তুলতে হবে।

যে সংস্থায় কাজ করছেন সেটি সম্পর্কে গবেষণা করতে হবে। যেমন মনজোতে আমরা প্রত্যেক কর্মীর মধ্যে উন্নয়ন ও উদ্ভাবনী মনোভাব গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করেছি। আমরা এমন লোকদের খুঁজি, যাঁদের উদ্দেশ্য এই রকম। এটাই আপনাকে আলাদা করে তুলতে পারে।
মনজো ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী টি এস অনিল

চার্টার্ড ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী অ্যান ফ্রাঙ্কে বলেন, ‘আমি এমন লোকদের সন্ধান করি, যাঁরা ব্যাপক চাপের মধ্যে জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারেন।’ তিনি বলেন, শুরুতেই কেউ নিজের নির্বাচিত সেক্টরে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হন না। এই অভিজ্ঞতার ভালো বিকল্প হিসেবে ‘সাশ্রয়ী অনলাইন কোর্স বা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে’ কাজ করার চেষ্টা করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। ফ্রাঙ্কে বলেন, ‘আপনি কীভাবে দক্ষতা অর্জন করেছেন, তা দেখানোর ক্ষেত্রে সৃজনশীল হতে হবে।’

মনজো ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী টি এস অনিল বলেন, ‘যে সংস্থায় কাজ করছেন সেটি সম্পর্কে গবেষণা করতে হবে। যেমন মনজোতে আমরা প্রত্যেক কর্মীর মধ্যে উন্নয়ন ও উদ্ভাবনী মনোভাব গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করেছি। আমরা এমন লোকদের খুঁজি, যাঁদের উদ্দেশ্য এই রকম। এটাই আপনাকে আলাদা করে তুলতে পারে।’
এ ছাড়া মজার একটি পরামর্শ দিয়েছেন ওয়াটারস্টোনের প্রধান নির্বাহী জেমন ডোন্ট। তিনি বলেন, সব সময় শুরু থেকে শুরু করার শক্তি রাখুন। আপনার অভিজ্ঞতা নেই কিন্তু কাজটা নেওয়া দরকার। এর অর্থ একদম প্রথম থেকে শুরু করা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বেকার হয়েছেন। আইএলও বলছে, মহামারিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে বেকার, সেই সঙ্গে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণও ব্যাহত হচ্ছে তাদের। এতে তাদের চাকরিতে প্রবেশ ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে।

খারাপ বাজারে নতুন চাকরি পেতে যা প্রয়োজন

আবারও মহামন্দার প্রসঙ্গে আসি। ওই মন্দায় বেকারত্ব পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল, তা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যানটা দেখলেই বোঝা যায়। ১৯২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হার প্রায় শূন্যের কাছে ছিল। সেই বেকারত্বের হার ১৯৩৩ সালে গিয়ে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশে ঠেকে। অর্থাৎ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রায় দেড় কোটি মানুষ বেকার ছিলেন। করোনার এই কালেও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। ভয়াবহ এক প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে মানুষ।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বেকার হয়েছেন। আইএলও বলছে, মহামারিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে বেকার, সেই সঙ্গে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণও ব্যাহত হচ্ছে তাদের। এতে তাদের চাকরিতে প্রবেশ ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে।

এমনিতেই চাকরির বাজার খুব দ্রুত ‘ডিজিটাল’ হয়ে উঠছিল। করোনার এই সময়ে তো আরও বেশি। কম্পিউটারের কাজ তাই যতটা সম্ভব শিখে রাখা দরকার। বিভিন্ন কর্মশালায় অংশগ্রহণ করাও জরুরি। নেটওয়ার্কিং করা জানতে হবে। আর প্রয়োজন কর্মস্পৃহা ও আত্মবিশ্বাস। ফোর্বস–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কাজের ক্ষেত্রে দুটোই খুব খারাপ, এক অতি অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া আবার অস্থির হয়ে বারবার চাকরি ছেড়ে দেওয়া। দীর্ঘদিন ধরে একটি চাকরি করতে করতে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে মানুষ। হঠাৎ করে তা হারালে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। আর করোনার এই সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জই হলো নতুন এই স্বাভাবিকতাকে মেনে নেওয়া।