সুয়েজ খালের রাজনৈতিক-অর্থনীতি

লোহিত সাগরের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের সংযোগ স্থাপনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য নিয়ে সুয়েজ খাল খনন করা হয়। বিশ্ব বাণিজ্যের ১২ শতাংশের বেশি পণ্য পরিবহন হয় এই খাল দিয়ে। এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যের প্রাণভোমরা হলো মিসরের এই খাল। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে এক দশকে খালটি খনন করা হয়।

এক দশক ধরে খালটি খননের কাজে নিয়োজিত ছিলেন ১০ লাখ মিসরীয়। নির্মাণসামগ্রী পরিবহন করা হতো উট ও খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে। জানা যায়, সুয়েজ খাল নির্মাণ প্রক্রিয়ায় হাজারো মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর ১৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটিতে প্রথম জাহাজ ভাসে। খালটির বিষয়ে ওই সময় বলা হয়, সাগরে বাতাস অনুকূলে থাকলে বিপজ্জনক কঠিন পথ এড়িয়ে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল হয়ে দ্রুত এশিয়ায় যাতায়াত করা যাবে। তবে ব্যাপারটি এত নিষ্কণ্টক ছিল না। এ নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি।

বহুদিন ধরেই সুয়েজ খাল নিয়ে মানুষের প্রবল আগ্রহ। সম্প্রতি বিশাল এক পণ্যবাহী জাহাজ খালটিতে আটকে গেলে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্র আসে সুয়েজ খাল। প্রায় এক সপ্তাহের চেষ্টায় জাহাজটি সরানোও গেছে। এভার গিভেন নামের জাপানি মালিকানাধীন জাহাজটি আটকে রেখে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান শুরু করেছে মিসর। যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করা হচ্ছে। জাহাজ চালানোয় ভুল হয়েছিল কি না, তা দেখা হচ্ছে। ক্যাপ্টেনকে জেরা করা হচ্ছে। এমনকি সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ হুঁশিয়ার করেছে যে তদন্তে সহযোগিতা না করলে জাহাজের ক্রুদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা হবে।

১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে মিসরের তৎকালীন আইকনিক প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের আরব বিশ্বের একতার রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি ব্রিটিশ ও ফরাসি স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে খালটি পরিচালনাকারী সংস্থা সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করেন।

মিসরের এক টিভি সাক্ষাৎকারে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ওসামা রাবি বলেছেন, জাহাজটিকে ভাসানোর খরচ এবং ছয় দিন ধরে খালটি বন্ধ থাকার জন্য ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার বা তার বেশি হতে পারে। জাপানি জাহাজমালিকের কাছ থেকে এই ক্ষতি দাবি করা হবে কি না, তা অবশ্য খোলাসা করেননি রাবি।

কিন্তু টাকার এই লোকসানের চেয়ে অন্য আরেকটি বিষয় এখন হয়তো মিসরের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেটি হলো, দুর্ঘটনার পর নতুন করে সুয়েজ খালের বিকল্প খাল নিয়ে আলোচনা, যদিও তা নতুন কিছু নয়। ব্যাপারটা হলো, সুয়েজ খাল যেমন মিসরের আয়ের বড় একটি পথ, তেমনি এই খাল নিয়ে মিসরের বিপদও কম নয়। আধুনিক ইতিহাসে মিসরের ওপর যত যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার সব কটি সুয়েজ খালের দখল নিয়ে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ইসরায়েল। সুয়েজ খালের ওপর তাদের শ্যন দৃষ্টি অনেক আগে থেকেই। আর মিসরের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম—বছরে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার নগদ আয়, যা তার আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম উৎস। ফলে এই আয় বৃদ্ধিতে মিসর নানা রকম প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলও বসে নেই।

১৯৫৬ সালে ইসরায়েল সুয়েজের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সমর্থন নিয়ে মিসরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছিল। বাস্তবতার কারণে হয়তো বিষয়টি বারবার চাপা পড়েছে, কিন্তু অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে ইসরায়েল কখনোই সরেনি।

১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে মিসরের তৎকালীন আইকনিক প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের আরব বিশ্বের একতার রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি ব্রিটিশ ও ফরাসি স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে খালটি পরিচালনাকারী সংস্থা সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করেন। ওই সিদ্ধান্তের ফলে নিজ দেশে প্রেসিডেন্ট নাসেরের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। তবে তা আন্তর্জাতিক সংকটের সৃষ্টি করে। এর তিন মাস পর সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণকারী দুই দেশ ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পাশাপাশি ইসরায়েল মিসরে হামলা চালায়। এরপর সুয়েজ খালটি ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চলা আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

ইসরায়েল সময় সময় সুয়েজ খালের বিকল্প খাল খননের কথা বলেছে। মিসর-ইসরায়েল সীমান্ত দিয়ে বিকল্প যে খাল কাটার পরিকল্পনা তার আছে, তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথের ওপর মিসরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ খর্ব করা। বিশ্লেষকদের মত হচ্ছে, সুয়েজের বিকল্প যে খাল ইসরায়েল চায়, তার পেছনে অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করছে ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ।

তাই বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মিসরের কাছে সুয়েজ খালের অর্থনৈতিক গুরুত্বই একমাত্র বিবেচ্য নয়। আঞ্চলিক ইস্যুতে প্রভাব তৈরির ক্ষেত্রে যতটুকু অস্ত্র মিসরের তূণে আছে, সুয়েজ খাল তার অন্যতম। বলা যায়, মিসরের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে এই খাল। আমেরিকা যেসব কারণে মিসরকে গুরুত্ব দেয়, সেটির পেছনেও রয়েছে সুয়েজ খাল। সুতরাং, বিকল্প একটি খাল এবং এই জলপথের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া হবে মিসরের জন্য একটি বিপর্যয়। মধ্যপ্রাচ্যে মিসরের প্রভাব এবং গুরুত্ব দারুণভাবে মার খাবে।