মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমাতে হবে, সংলাপে বক্তাদের মত
শুধু বাজার তদারকি কিংবা চাঁদাবাজি কমানোর মাধ্যমে বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমানো যাবে না। দীর্ঘ মেয়াদে নিত্যসামগ্রীর দাম কমাতে হলে পণ্যের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে সরকারের নীতির স্থিতিশীলতা থাকতে হবে।
আজ শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ভয়েস ফর রিফর্ম আয়োজিত এক সংলাপে এসব কথা বলেন বক্তারা। ‘দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি: সংকট সমাধানের আশু উপায়’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা আরও বলেন, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভুল নীতির কারণে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে এসব নীতির সংশোধন করতে হবে।
সংলাপের সঞ্চালনা করেন ভয়েস ফর রিফর্ম প্ল্যাটফর্মের সহ-আহ্বায়ক ও তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা ফাহিম মাশরুর। তিনি বলেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পরে আমরা আশা করেছিলাম, জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমবে; কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে আজকের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে।’
অনুষ্ঠানে মূল আলোচক ছিলেন এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিরডাপ) পরিচালক (গবেষণা) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান ও চালডালের প্রধান নির্বাহী (সিইও) ওয়াসিম আলীম।
সিরডাপ পরিচালক (গবেষণা) মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পেছনে যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়, আমি তা ঠিক মনে করি না। কোনো সিন্ডিকেট দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ দাম ধরে রাখতে পারে না, বরং অতীতে নেওয়া বিভিন্ন সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির কারণে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। আগের সরকারের প্রবৃদ্ধি দেখানোর নীতির নেতিবাচক ফল হচ্ছে আজকের মূল্যস্ফীতি।
মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতি এবং চাঁদাবাজির মতো খরচের কারণে জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়ে, কিন্তু তা সাময়িক। উৎপাদন ব্যয়ের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। সে জন্য দীর্ঘ মেয়াদে পণ্যের দাম কমাতে হলে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হওয়া জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ বলে মনে করেন চালডালের সিইও ওয়াসিম আলীম। তিনি বলেন, আড়াই বছরের মধ্যে ১ ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে ১২০ টাকা হয়েছে। এটি মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। বিগত সময়ে অবাধে টাকা ছাপানো ও টাকা পাচারের কারণেও দ্রব্যমূল্যে প্রভাব পড়েছে।
ওয়াসিম আলীম আরও বলেন, এখন জিনিসপত্রের দাম কমাতে হলে পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বেশ কিছু পণ্যে আমদানি শুল্কও কমাতে হবে। বিশেষ করে দেশে প্রোটিন খাওয়া বেড়েছে; এখানে যত আমদানি শুল্ক আছে, তা তুলে নেওয়া উচিত। এ ছাড়া শুল্ক কমালে চাল, চিনি, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল—এ ধরনের পণ্যের দামও কমা উচিত।
অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান বলেন, ২০১৪-১৯ সময়ে দেশে করোনা ছিল না, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়নি, মুদ্রার বিনিময় হার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। তখনো দেশে প্রায় ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল। অথচ একই সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি তুলনামূলক কম ছিল। তখন অর্থনীতি ঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। পরে বৈশ্বিক নানান চ্যালেঞ্জের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে আজকের পর্যায়ে উঠেছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান সামষ্টিক নীতির মাধ্যমেই করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সাময়িকভাবে প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও তা মেনে নিতে হবে।
উন্মুক্ত আলোচনায় শপআপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মোকামের চিফ অব স্টাফ জিয়াউল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘দেশে পণ্য উৎপাদন ও চাহিদার বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে জন্য আমরা পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ বিবেচনা করে দীর্ঘ মেয়াদে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত পরবর্তী এক-দুই বছরে পেঁয়াজের মতো পণ্য রপ্তানি করবে কি না, সেটা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়।’
এসিআই লজিস্টিকসের (স্বপ্ন) হেড অব বিজনেস (কমোডিটি) নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, ‘পচনশীল পণ্যের জন্য আমাদের সরবরাহ খাত উপযোগী নয়। পণ্যের অপচয় কমিয়ে আনা গেলে জিনিসপত্রের দাম অনেকটা কমবে।’
উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তারা বাজার তদারকিতে জোর দেন। তাঁরা বলেন, গত দেড় মাসের মধ্যে চালের দাম তিন থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে; এর কারণ ধানের দাম বেড়েছে। কিন্তু ধানের বাজার তদারক করা হয় না। এ ছাড়া পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের ওপর অতিনির্ভরতা কমিয়ে আনারও পরামর্শ দেন তাঁরা।