সঞ্চয়পত্রসহ ছয় খাতের উৎসে কর আর চূড়ান্ত দায় নয়

সঞ্চয়পত্র
প্রতীকী ছবি

সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর কেটে নেওয়া উৎসে কর এখন থেকে চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচিত হবে না। শুরুতে মুনাফা তোলার সময় উৎসে কর হিসেবে টাকা কেটে রাখা হবে। পরে রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় যদি বাড়তি কর দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই বাড়তি টাকাও দিতে হবে।

তবে কেটে রাখা উৎসে কর ন্যূনতম কর হিসেবে বিবেচিত হবে; অর্থাৎ বছর শেষে যদি হিসাব করে দেখা যায়, নানা ধরনের রেয়াত নেওয়ার পর ওই করদাতার করের পরিমাণ উৎসে কেটে রাখা করের তুলনায় কম হয়, তাহলে সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে কেটে রাখা কর ফেরত পাওয়া যাবে না।

নতুন আয়কর আইনে সঞ্চয়পত্রসহ ছয়টি খাতের উৎসে করকে চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। আগের আইনে ৮২(সি) ধারায় ওই ছয় খাতের কর্তন করা উৎসে করকে চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু নতুন আইনের ন্যূনতম কর অংশে এই ধরনের চূড়ান্ত কর দায়ের ছকটি আর রাখা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে একধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।

এবার দেখা যাক, কেটে রাখা উৎসে করই চূড়ান্ত দায়—এমন বাকি পাঁচটি খাতগুলো কী ছিল। এগুলো হলো রপ্তানির নগদ সহায়তা, জমি বিক্রি থেকে আয়, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আমানতের মুনাফা, জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ ও আবাসন কোম্পানির সঙ্গে সাইনিং মানির প্রাপ্ত অর্থ।

সঞ্চয়পত্রের মুনাফা, রপ্তানির নগদ সহায়তা এবং রিটার্ন দাখিলে বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি প্রাপ্ত (১০ লাখ টাকা পর্যন্ত মেয়াদি আমানত থাকলে) সঞ্চয়ী আমানত ও স্থায়ী আমানত ইত্যাদির ওপর সুদ বা মুনাফার ওপর উৎসে কর কর্তনকে চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা, রপ্তানির নগদ সহায়তা ও রিটার্ন দাখিলে বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত (১০ লাখ টাকা পর্যন্ত মেয়াদি আমানত থাকলে) সঞ্চয়ী আমানত ও স্থায়ী আমানত ইত্যাদির ওপর সুদ বা মুনাফার ওপর উৎসে কর কর্তনকে চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। শিগগিরই এ ধরনের প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।

কেন চূড়ান্ত কর দায় করা হয়েছিল

এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আগের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর কোনো কর ছিল না। এক দশক আগে প্রথমবারের মতো উৎসে কর বসানো হয়। প্রথমে ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর বসানো হয়। পরে ২০১৯ সালে উৎসে করের হার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।

সঞ্চয়পত্রে মুনাফার ওপর উৎসে করকে চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে গণ্য করার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে বিবেচনা করা হয়েছিল। যেহেতু ছোট করদাতারা সঞ্চয় করেন, তাই তাঁদের অন্য কোনো আয় থাকলে তার ওপর প্রযোজ্য কর যুক্ত হয়ে করের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া এ দেশের নারীরা পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন। সঞ্চয়পত্র আসলে একধরনের সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে করকে চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে গণ্য করা হয়।

নতুন আইনে কোনো এক আয়বর্ষে বিনিয়োগ করা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর কোনো কর নেই। অন্য সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখার বিধান আছে, যা ন্যূনতম কর হিসেবে দিতে হবে।

রপ্তানির বিপরীতে রপ্তানিকারকেরা ৪৩ ধরনের পণ্য রপ্তানি করে ১ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা পান। ১০০ টাকা রপ্তানি করলে সর্বোচ্চ ২০ টাকা পর্যন্ত নগদ সহায়তা দেয় সরকার। রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে সরকার এই উৎসাহ দেয়। কিন্তু আগে এ ধরনের নগদ সহায়তার ওপর উৎসে কর কেটে রাখা হতো না। ২০১২ সালে প্রথমে ৫ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এনবিআরের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, হিসাব রাখার স্বার্থে উৎসে কর বসানো হয়েছিল।

অন্যদিকে জমি বিক্রির আয়ের ওপর ১০-১৫ শতাংশ হারে কর আরোপিত আছে। নতুন আইনে জমি নিবন্ধনের সময় উৎসে কর হিসেবে দলিল মূল্যের ৮ শতাংশ বা ন্যূনতম জমির মূল্য ধরে কর নির্ধারণ করা হয়। আগে জমি নিবন্ধনের সময় দেওয়া উৎসে করকে চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে বিবেচিত হতো, এখন থেকে আর হবে না। এর ফলে জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় ছোটখাটো জমির মালিকদের ওপরও করের বোঝা বাড়তে পারে।

সরকার নানা কাজে প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে জমি অধিগ্রহণ করে। গ্রামগঞ্জের কৃষিজমি বা কম দামি জমি অধিগ্রহণই বেশি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিমালিকদের সরকার ক্ষতিপূরণ দেয়। সেই ক্ষতিপূরণের টাকার ওপর উৎসে কর বসানো হতো আগের আইনে। ক্ষতিপূরণকে আয় হিসেবে দেখা হয়। সিটি বা পৌর এলাকায় এই হার ৬ শতাংশ এবং এর বাইরের এলাকায় ৩ শতাংশ উৎসে কর আরোপ হয়। আগের আইনে এটি চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন থেকে তা আর হবে না।

একইভাবে ল্যান্ড ডেভেলপারদের সঙ্গে চুক্তির সময় জমির মালিক সাইনিং মানি পান। এর ওপর ১৫ শতাংশ উৎসে কর বসে। আগে এই কর চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচিত হতো, নতুন আইনে তা হবে না।

এ ছাড়া এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তহবিল স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা হয়। এই আমানত থেকে পাওয়া মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎস কেটে রাখা হয়, যা আগে চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে বিবেচিত ছিল।