দক্ষিণ কোরিয়ায় নগদ অর্থের লেনদেন ছাড়াই পুরো ছয় দিন

নগদ অর্থবিহীন জীবন কিন্তু আর কল্পনার বিষয় নয়। সুইডেন এখন দুনিয়ার একমাত্র ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’। পথে আছে আরও কয়েকটি দেশ। এ রকমই এক দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল—এ নিয়েই মূল লেখা

এবার একটা বিতর্কের কথাও বলি। হার্ভে ফ্রেডরিক ওয়াকসম্যান ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত নিউরোসার্জন ও আইনজীবী। মূলত জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এ ১৯৯০ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংখ্যায় তাঁর একটি মতামত ছাপা হয়েছিল। সেখানে তিনি নগদ অর্থের লেনদেন বাতিল করার পক্ষে জোরালোভাবে কলম ধরেছিলেন।

বলেছিলেন, এতে লেনদেনের হিসাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাখা যাবে, এতে কালোটাকা কমবে, সরকারের কর আদায় বাড়বে, অপরাধও কমবে। তাঁর এই বক্তব্য ঘিরে বিতর্ক হয়েছিল তখন। এর পক্ষে-বিপক্ষে কয়েকটি লেখা ছেপেছিল নিউইয়র্ক টাইমস। এর মধ্যে রিচার্ড হায়েস নামের একজন লিখেছিলেন, সব লেনদেনের রেকর্ড থাকবে বলে ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’র পরিবর্তে অচিরেই ‘বিগ ব্রাদার সোসাইটি’র উদ্ভব ঘটবে। এই ব্রিগ ব্রাদাররা সাধারণ মানুষের সব তথ্য জানতে পারবে, ফলে ব্যক্তিগত বলতে আর কিছু থাকবে না। তাঁর মতে, সেটি হবে নজরদারির একধরনের সোভিয়েত ইউনিয়ন পদ্ধতি।

দক্ষিণ কোরিয়ার ইঞ্চন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের অন্যতম বড় ও ব্যস্ত বিমানবন্দর। সবচেয়ে কম সময়ে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও এই বিমানবন্দর অন্যতম সেরা। ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে লাগেজ নিয়ে বের হতে ১০ মিনিটের বেশি সময় লাগল না। এসেছি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৫৬তম বার্ষিক সম্মেলনে, তাদেরই আমন্ত্রণে। বের হওয়ার সময়েই গেটের কাছে অর্থ ভাঙানোর কাউন্টার চোখে পড়েছে। তারপরও মনে হলো, আগে হোটেলে যাই, যে যৎসামান্য ডলার আছে, সেখানেই ভাঙানো যাবে।

বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যেতে আয়োজকেরাই বাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। হোটেলে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রুমে উঠতে উঠতে বিকেল পাঁচটা বেজে গেল। তখনো দুপুরের খাওয়া হয়নি। সুতরাং প্রথম কাজ খাবারের সন্ধানে বের হওয়া। সমস্যা হলো কোরিয়ার কোনো মুদ্রা হাতে নেই। হোটেল থেকে বলল, ব্যাংক ছাড়া ডলার ভাঙানোর কোনো সুযোগ নেই, ব্যাংক খুলবে পরের দিন সকালে। সুতরাং একমাত্র ভরসা ক্রেডিট কার্ড।

স্কাইপার্ক হোটেলটি ইঞ্চনের সংদো এলাকায়। ১৫ মিনিট হাঁটতেই একটা বড় মার্কেট এলাকা চোখে পড়ল। ভেতরে যেতেই বুঝলাম এটা আসলে রেস্তোরাঁ এলাকা। অনেক রেস্তোরাঁর ভিড়ে একমাত্র পরিচিত নাম বার্গার কিং। মনে হলো প্রথম দিন খাবার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করাই ভালো। তবে ভেতরে ঢুকতেই আরেক বিপত্তি। সরাসরি খাবারের অর্ডার নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। আছে কেবল খাবার হাতে নেওয়ার একটা কাউন্টার।

রাজধানীর মতিঝিলের ১ হাজার ২০০ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিউআর কোডে টাকা লেনদেনের সুযোগ পাচ্ছেন। পর্যায়ক্রমে দেশের বড় শহরগুলোর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের এ ধরনের লেনদেনের আওতায় আনা হবে।
প্রথম আলো

আর আছে খাবার অর্ডার নেওয়ার চারটা যন্ত্র। চার দেশের পতাকার ছবি দেওয়া আছে, অর্থাৎ চার ভাষায় অর্ডার দেওয়া যায়। যেমন কোরিয়া, চীন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর দাম পরিশোধ করতে হয় ক্রেডিট কার্ড বা মোবাইল মানির মাধ্যমে।

লম্বা যাত্রা শেষে কোরিয়া পৌঁছাই ১ মে, আর ফিরে আসি ৬ মে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার খাবার কিনতে হয়েছে, টুকিটাকি শপিং করেছি, কোরিয়ার কে-ড্রামা ও কে-পপ ভক্ত মেয়ের জন্য প্রসাধনী কিনতে হয়েছে, ট্যাক্সিতে উঠেছি চারবার, বৃষ্টি ছিল বলে ছাতাও কিনেছি। সব মিলিয়ে অনেকবারই লেনদেন করতে হয়েছে। কিন্তু পকেটে যে ডলার ছিল, তা পকেটেই থেকে গেছে। ছয় দিনে একবারও নগদ অর্থ খরচ করতে হয়নি, কোরিয়ার মুদ্রা ওন কেমন, তা দেখাও হয়নি। এমনকি নগদ অর্থের লেনদেন করতে দেখিনি কোথাও। সুপারস্টোরে নগদ লেনদেনের জন্য আলাদা অল্প কয়েকটি কাউন্টার আছে বটে, তবে তা সম্ভবত বয়স্কদের জন্য। অন্যদের নিজেদেরই বারকোড মিলিয়ে পণ্যের দাম পরিশোধ করতে হয়। আবার অনেক দোকানেই দেখেছি লেখা আছে কেবল ক্রেডিট কার্ডই তাঁরা গ্রহণ করেন।

তবে শেষ পর্যন্ত কোরিয়ার ১ হাজার ওন-এর একটি নোট ঠিকই দেখেছিলাম। ঢাকায় ফেরার প্লেন ছিল সকাল নয়টায়। বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে সেতুতে টোল দিতে হয়েছিল একবার। তখন ট্যাক্সিচালক নগদ একটি নোট দিয়ে টোল পরিশোধ করেছিলেন। পুরো ছয় দিনে সেটাই ছিল আমার একমাত্র নগদ অর্থ দর্শন।

ক্যাশলেস সোসাইটির ধারণা যেভাবে

নগদ অর্থ ছাড়াই সব ধরনের লেনদেন করাকে বলা হচ্ছে ক্যাশলেস সোসাইটি প্রতিষ্ঠা। মানুষ যখন উড়তে শেখেনি, তারও বহু আগে লেওনার্দো দা ভিঞ্চি হেলিকপ্টারের নকশা এঁকে লিখেছিলেন। জুলভার্ন যখন বেলুনে চড়ে আকাশ পাড়ি দেওয়ার গল্প লিখতেন, তখনো উড়োজাহাজের কথা কারও কল্পনায় ছিল না। তেমনি নগদ অর্থ লেনদেন নিয়েও এ রকম এক গল্প আছে। এডওয়ার্ড বেলেমি ছিলেন একাধারে মার্কিন লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ।

১৮৯৮ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। শুরুতে কয়েকটি ব্যর্থ উপন্যাস লিখেছিলেন। তবে তাঁকে খ্যাতি এনে দেয় ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত লুকিং ব্যাকওয়ার্ড নামের উপন্যাসটি। সেই উপন্যাসে তিনি লিখেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে, যখন নগদ অর্থের আর কোনো লেনদেন হবে না, নগদ নোটের জায়গা দখল করবে কার্ডভিত্তিক লেনদেন। এখানে মনে রাখা ভালো যে এক ডলার নোটেরই জন্ম ১৮৬২ সালে, আর প্রথম ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন শুরু ১৯৫০ সালে। সুতরাং ১৮৯৭ সালে কার্ডভিত্তিক লেনদেন চালু করার কথা ভাবতে পারাটা ছিল ভিন্ন কিছু।

প্রথম উদাহরণ সুইডেন

সেই ক্যাশলেস সোসাইটিই এখন বড় বাস্তবতা, যার অনেকটা নজির দেখা গেল দক্ষিণ কোরিয়ায়। যদিও ক্যাশলেস দেশের সবচেয়ে বড় উদাহরণ এখন সুইডেন। তারা বেশ কয়েক বছর আগেই ঘোষণা দিয়েছিল যে ২০২৩ সালের মার্চে তারা পুরোপুরি ‘ক্যাশলেস’ হয়ে যাবে। অর্থাৎ আর কোনো নগদ অর্থের লেনদেন নয়। এ জন্য অবশ্য দেশটি দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েছে। নতুন আইনও করেছে। ফলে এখন ব্যক্তিগত সংগ্রহ বা জাদুঘর ছাড়া সুইডেনের মুদ্রা ক্রোনার আর দেখা যাবে না। মজার ব্যাপার হলো, ১৬৬১ সালে ইউরোপে সুইডেনই প্রথম দেশ, যারা ব্যাংক নোট চালু করেছিল। আর সেই সুইডেনই প্রথম ব্যাংক নোট লেনদেন বন্ধ করে দিল।

সুইডেন ছাড়াও বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশের ক্যাশলেস সোসাইটি হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। চীন ২০২০ সালে তাদের মুদ্রা ইয়েনকে ডিজিটালে রূপান্তর করার একটি পাইলট কর্মসূচি চালু করেছে। ফিনল্যান্ডে এখন ৯৮ শতাংশ লেনদেন হয় নগদ অর্থ ছাড়াই। তারা ২০২৯ সালের মধ্যে পুরোপুরি ক্যাশলেস হয়ে যাবে। পুরোপুরি ক্যাশলেস হওয়ার পথে নরওয়েও। সেখানে মাত্র ৪ শতাংশ লেনদেন হয় নগদ অর্থে। এ রকম আছে আরও কিছু দেশ।

প্রযুক্তির দিক থেকে অন্যতম উন্নত দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। এখানে স্মার্টফোন ব্যবহারের হার ১০০ শতাংশ। দেশটির তরুণ প্রজন্ম একদমই নগদ অর্থ বহন করতে আগ্রহী নয়। ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ডের বহুল ব্যবহার তো আছেই। তবে কোরিয়ায় মোবাইল লেনদেনে জনপ্রিয় নাম হচ্ছে স্যামসাং পে, কাকাও পে ও নাভের পে। কোরিয়া ধারণার তুলনায় দ্রুতগতিতে ক্যাশলেস সোসাইটি হতে যাচ্ছে মূলত কোভিড-১৯-এর কারণে। এর পর থেকেই নগদ লেনদেন একদমই কমে গেছে।

অর্থ ছাড়া লেনদেনের নানা পদ্ধতি

একটা সময় ছিল নগদ অর্থ ছাড়া লেনদেনের কোনো উপায় ছিল না। এরপর এল ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড। আর এখন দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং ও ওয়ালেট অ্যাপ, যার মাধ্যমে অর্থ লেনদেন, সব ধরনের পরিশোধ, অর্থ জমানোসহ সবই করা সম্ভব।

এমনকি ব্যাংকের সঙ্গেও সরাসরি লেনদেন করা যাচ্ছে। অনলাইনে অর্থ পরিশোধের জন্য তৈরি করা হয়েছে ভার্চ্যুয়াল কার্ড। কিউআর কোডভিত্তিক পরিশোধের ব্যবস্থাও এখন যথেষ্ট জনপ্রিয়। এ ছাড়া আছে স্পর্শবিহীন অর্থ পরিশোধ ব্যবস্থা নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন (এনএফসি), এখনো আছে স্মার্টফোন যাঁদের নেই, তাঁদের জন্য ডায়ালভিত্তিক (ইউএসএসডি) ব্যবস্থা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নগদ অর্থ ছাড়াই লেনদেনের জন্য অনেক ব্যবস্থাই তৈরি করা হয়েছে।

নগদবিহীন লেনদেনে প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল ক্রেডিট কার্ড আবিষ্কার। তবে আসলে স্মার্টফোন আবিষ্কারই নগদ অর্থ ছাড়াই লেনদেনে বিপ্লব এনেছে। বিশ্বে এখন মোবাইলভিত্তিক অর্থ লেনদেন ব্যবস্থায় শীর্ষে আছে চীনের আলি পে। ২০১৩ সালেই তারা পেপলকে ছাড়িয়ে যায়। আলিপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩০ কোটি। এরপরই আছে চীনেরই উইচ্যাট পে। এ ছাড়া শীর্ষ দশে আরও আছে অ্যাপল পে, গুগল পে, পেপল, পেটিম, ভারতের ফোন পে, দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং পে, ভেনমো এবং যুক্তরাজ্যের ক্যাশ অ্যাপ। বাংলাদেশে এ রকম যেমন আছে বিকাশ, রকেট ও নগদ।

রাজধানীর মতিঝিলে মুচির দোকানেও ‘ডিজিটাল’ লেনদেন সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে
প্রথম আলো

কর ফাঁকি, কালোটাকা ও অর্থ পাচার বন্ধ করতে হলে নগদ লেনদেনও বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক ডাকাতি বা অর্থ ছিনতাইয়ের ঘটনাও বন্ধ হবে এতে। যেমন ফিনল্যান্ডে ব্যাংক ডাকাতি একদমই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার অর্থ ছাপানো, পরিবহন ও বণ্টনে যে বিপুল ব্যয়, তারও সাশ্রয় হবে।

তবে এর উল্টো দিকও আছে। যেমন ফিনল্যান্ডে ব্যাংক ডাকাতি বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবে বেড়ে গেছে সাইবার অপরাধ। সুতরাং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারপরও এর সুবিধাই বেশি। ফলে উন্নত দেশগুলোর লক্ষ্য ক্যাশলেস সোসাইটি হওয়া।

এই লক্ষ্যের কথা বাংলাদেশও বলছে। সব ধরনের বিল এখন সহজে দেওয়া যাচ্ছে। নগদ অর্থবিহীন লেনদেনও বেড়েছে। তারপরও ক্যাশলেস সোসাইটি হতে যেতে হবে বহু বহু দূর।