কামাল কাদীরের বিকাশ গড়ে তোলার গল্প: ‘আমি ওয়াল স্ট্রিটে কাজ করার মানুষ নই’

কামাল কাদীর, সিইও, বিকাশ

নিউইয়র্কের একটি বেসরকারি ইকুইটি কোম্পানিতে এক গ্রীষ্মে কাজ করেছিলেন কামাল কাদীর। তবে সেটা যে তাঁর কর্মক্ষেত্র হতে পারে না, তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি।

মার্টিন ট্রাস্ট সেন্টার ফর এমআইটি এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপে ছাত্র, শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় এভাবেই নিজের জীবনের গল্প বলছিলেন বর্তমানে বিকাশের প্রধান নির্বাহী কামাল কাদীর। ‘আমি ঠিক ওয়াল স্ট্রিটে কাজ করার মতো মানুষ নই। বুঝতে পারলাম, যেখানে আমি একাত্মবোধ করি, আমি যা করি তা যেখানে উপভোগ করতে পারব, সেখানে আমার কিছু করতে হবে। তাই আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি।’

দেশে ফিরে প্রথমে অনলাইন বেচাকেনার প্ল্যাটফর্ম সেল বাজার তৈরি করেন কামাল কাদীর। এরপর ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ।

চলতি বছরের মার্চে কামাল কাদীর ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বিকাশ সম্পর্কে অনেক কথাই বলেন। বিকাশ দেশের একমাত্র ইউনিকর্ন, যে কোম্পানির বাজারমূল্য ১০০ কোটি ডলার বা তার চেয়ে বেশি।

তবে কামাল কাদীর পরিষ্কার করেই বলেন, ইউনিকর্নের মর্যাদা লাভ করা বা অন্যান্য কৃতিত্ব বিকাশের গল্পের মূল কথা নয়, বরং বিকাশের সব কার্যক্রমের মূলে রয়েছে মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি।

কামাল কাদীর মূলত শিল্পকলা ও অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওবারলিন কলেজে। পড়াশোনা শেষ করে বাংলাদেশে ফেরার পর তিনি ভিন্ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তিনি এমআইটির স্লোয়ানসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করেন। ২০০৩ সালে ভালোবাসা দিবসে কামাল কাদীর রড গার্সিয়ার ফোনকলে জানতে পারেন, তিনি এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। সেই খবর পেয়ে কামাল কাদীর খুব খুশি হন।

রড গার্সিয়া এমআইটি স্লোয়ানে ৩৩ বছর ভর্তি বিভাগের সহকারী ডিন হিসেবে কাজ করেছেন। কামাল কাদীর বলেন, গার্সিয়া তাঁর জীবন বাঁচিয়েছেন। তাঁর এই সাবেক ছাত্রের কথা তিনি সস্নেহে স্মরণ করেন। তাঁর জমানায় যে ১৪ হাজার ছাত্র এমআইটিতে ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের অনেকের কথাই গার্সিয়ার স্মরণে আছে।

রড গার্সিয়া বলেন, ‘এমআইটি স্লোয়ান খুবই ছোট একটি জায়গা। ফলে ছাত্র বা প্রশাসক যে–ই হোন না কেন, সেখানে সবাই সবাইকে ভালোভাবে বোঝাশোনার সুযোগ পান। এটা আমার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সত্য হয়ে ওঠে। এসব সম্পর্ক স্নাতক শেষ হওয়ার পরেও টিকে থাকে।’

কামাল কাদীর সম্পর্কে গার্সিয়া বলেন, ‘কামাল নীতিনিষ্ঠ ও উদ্ভাবনী নেতৃত্বের জীবন্ত নমুনা। তিনি সব সময় জগতের ভালো করার চেষ্টা করেন। সেল বাজার থেকে শুরু করে বিকাশ পর্যন্ত তাঁর উদ্ভাবনী নেতৃত্বের কল্যাণে ব্যাংকের আওতার বাইরে থাকা লাখো মানুষ উপকৃত হয়েছে।’

এমআইটির এমবিএ এক সীমাহীন চক্র থেকে বেরোতে সাহায্য করেছে বলে ট্রাস্ট সেন্টারের অভ্যাগতদের জানান কামাল কাদীর।

ওবারলিন কলেজে পড়াশোনা থেকে শুরু করে নিউইয়র্কে কাজ করা, এরপর বাংলাদেশ আসা - এই পুরোটা সময়ে তিনি সব সময়ই ‘কিছু একটা করতে হবে’ সেই তাগিদ অনুভব করেছেন। কখনো কখনো সফলতাও পেয়েছেন তিনি।

কামাল কাদীর বলেন, ‘এমআইটি স্লোয়ান থেকে স্নাতকোত্তর করার পর বুঝতে পারলাম, “কিছু একটা করতে হবে” - এই চেষ্টা বাদ দিয়ে সত্যিই কী করতে চাই তা এবার বের করতে হবে। সে জন্য স্নাতকোত্তর করার পর তিন মাস আমি শুধু ঘুরে বেরিয়েছি, আর কিছু নয়।’

কামাল কাদীর এই তিন মাস আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়া ঘুরে বেরিয়েছেন। সেই সময় তাঁর বেশ কিছু উপলব্ধি হয়।

মার্টিন ট্রাস্ট সেন্টার ফর এমআইটি এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপে আয়োজিত এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় (“ফায়ারসাইড চ্যাট”) শিক্ষার্থী ও অনুষদ সদস্যদের সাথে বিকাশ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও কামাল কাদীর
এমআইটি স্লোয়ান/টিম করিরা

আর্থিক অন্তর্ভুক্তির শক্তি

এই ভ্রমণের সময় কামাল কাদিরের সঙ্গে ফেরিতে ঘটনাচক্রে এক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সেখানে তিনি যাত্রীদের কাছে মাছ বিক্রির পাশাপাশি মুঠোফোনে দামাদামি করছিলেন; কিন্তু বিক্রেতা দাম কেবল কমাচ্ছিলেন। এ ঘটনা দেখে কামাল কাদীর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, বিষয়টি কী।

জবাবে সেই ব্যক্তি বলেন, ‘সন্ধ্যা সাতটার পর এখানে কেনার লোক থাকে না। আমি তো জেলে নই, স্থানীয় বাজার থেকে মাছ কিনে বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করি।’ তাঁর কথা শুনে কামাল কাদীরের মনে হলো, এভাবে বাজার সৃষ্টি করা সম্ভব। ১৫ ডলারের নোকিয়া ফোন দিয়ে কেউ নিজের বাজার তৈরি করতে পারেন।

সেই উপলব্ধি থেকে কামাল কাদীর সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মুঠোফোনে ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার কথা ভাবলেন, যাঁরা এর বদৌলতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত হবে।

কামাল কাদীর বলেন, ‘বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য আর্থিক সেবা ছিল না। ১৭ কোটি মানুষের বাজারে প্লাস্টিক কার্ড ছিল মাত্র আট লাখ। সে জন্য আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম, কীভাবে সব মানুষের কাছে আর্থিক সেবা নিয়ে যাওয়া যায়। যেখানে সবার একটি হিসাব থাকবে এবং তাঁরা চাইলে অর্থ সঞ্চয় থেকে শুরু করে স্থানান্তর ও গ্রহণ—সবকিছুই করতে পারবেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারও সবকিছু ডিজিটাল পদ্ধতিতে করার তাগাদা দেয়।’

কামাল কাদীর
ফাইল ছবি

সেখান থেকেই বিকাশের জন্ম। আজ এক দশক পেরোনোর পর বিকাশের মাধ্যমে দেশের মানুষ দৈনিক গড়ে ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি লেনদেন করছে। প্রথাগত শাখা ব্যাংকিং না করে বিকাশ দেশজুড়ে ৩ লাখ ৩০ হাজার এজেন্টের বড় এক যোগসূত্র তৈরি করেছে। এরা ‘মানব এটিএম’ হিসেবে কাজ করে। এরা কাগজের টাকা ডিজিটাল টাকায় রূপান্তর করে এবং তার উল্টোটাও করে। এই দুটি সাধারণ বিষয়ের কল্যাণে সাধারণ মানুষ ডিজিটাল মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় এসেছে।

এজেন্টদের পাশাপাশি দেশজুড়ে বিকাশের পাঁচ লাখ মার্চেন্ট আছে। এরা নগদ অর্থের পাশাপাশি ডিজিটাল পদ্ধতিতে কেনাবেচা করে। কামাল কাদীর বলেন, ‘মানুষের ক্ষমতায়ন হয়েছে, বিশেষ করে নারীদের...আমাদের গ্রাহকদের ৪৬ শতাংশই নারী।’

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে কাজ করে বিকাশ। এতে ব্র্যাক ব্যাংকের বড় বিনিয়োগ আছে। সেই সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ, দ্য বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, আলিবাবার অ্যান্ট ফাইন্যান্সিয়াল ও সফটব্যাংক ভিশন ফান্ডের বিনিয়োগ আছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত বিকাশের বাজারমূল্য ছিল ২০০ কোটি ডলারের বেশি। আর এসব কিছু সম্ভব হয়েছে মুঠোফোন সহজলভ্য হওয়ার কারণে। সেই সঙ্গে আছে ব্যাংকের আওতার বাইরে থাকা মানুষের ক্ষমতায়ন।

কামাল কাদীর বলেন, ‘বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করে না। ১২ বছর আগে যখন এমআইটিতে আসতাম, তখন সবাই পরিপ্রেক্ষিতের কথা না ভেবে স্মার্টফোন নিয়ে কথা বলতেন বা ব্যবহার করতেন। আমরা স্মার্টফোন অ্যাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সমাজের কেবল সচ্ছল মানুষেরাই আমাদের সেবা ব্যবহার করতে পারতেন। তাতে আমি যা করতে চেয়েছি, তা হতো না।’

আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উর্বর ভূমি

হিমালয় পর্বতমালা বাংলাদেশের উত্তরে কয়েক শ মাইল দূরে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এই পর্বতমালার বাস্তুতান্ত্রিক ও আর্থিক প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ।

বাংলাদেশ উর্বর পলিমাটির দেশ, সেই পলিমাটির একটি অংশ আসে হিমালয় পর্বতমালা থেকে। দেশের বড় একটি অংশ গাঙ্গেয় বদ্বীপ, বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ এটি।

বিমান থেকে প্রথমবার হিমালয় পর্বতমালা দেখার সময় কামাল কাদীরের মনে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি উদয় হয়।

‘আমার কাছে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বিষয়টি কিছুটা এ রকম। আগে মধ্যবিত্ত অর্থ উপার্জন করত এবং ব্যাংকে জমা করত, ব্যাংক তা উন্নয়নে কাজে লাগাত। এখন দেশের দরিদ্রতম মানুষের অর্থও এ ব্যবস্থার মধ্যে এসেছে, সেটাও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগে।’

সবশেষে কামাল কাদীর বলেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে অর্থনৈতিক পলি ও পানি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ধারাবাহিকভাবেই তা ঘটছে, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এই সব কিছুর অবদান আছে।’