সংস্কার না হলে নতুন সরকার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে না
অর্থনীতির বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি ও উত্তরণের উপায় নিয়ে প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া বর্তমান অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে। নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষে বড় ধরনের সংস্কার সম্ভব নয়। তবে নির্বাচনের পর সংস্কারের কৌশল কী হবে, তা এখনই ঠিক করতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ছিলেন চার অর্থনীতিবিদ, একজন সাবেক ব্যাংকার ও একজন ব্যবসায়ী।
অর্থনীতির বর্তমান যে সংকট, সেটি আমাদেরই সৃষ্টি। বহির্বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ হয়তো সেই সংকটকে ডান–বাম করেছে। নিজেদের কারণে সৃষ্ট দীর্ঘদিনের সমস্যা থেকে সরকার এখন অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে।
কিন্তু এখনো আমরা দেখছি, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আগামী নির্বাচনের কয়েক মাস বাকি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে অর্থনীতিতে বড় ধরনের মৌলিক কোনো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই সরকারকে এখন নির্বাচনপূর্ব বা আগামী তিন মাসের জন্য স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে নির্বাচন–পরবর্তী অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া না হলে যে সরকারই আসুক, তারা মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে না। কারণ, অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিকে পাঁচ বছর মেয়াদে টেনে নেওয়া সম্ভব না।
একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক না থাকলে কোনো রাজনৈতিক সরকারই টিকতে পারে না। সেটি আমরা শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ অনেক দেশে দেখেছি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকলে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও টিকতে পারে না। একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় একটি জিনিস থাকে, জনগণকে কিছু দিতে হয়। সেটি সৌদি আরবেই হোক, চীনেই হোক বা সোভিয়েত ইউনিয়নেই হোক।
জনগণকে কিছু দেওয়া হলে সে ক্ষেত্রে জনগণ সহ্য করে, অনেক দিন ধরেই করে। দিতে না পারলে টিকে থাকা কঠিন। সেই দিতে না পারার অবস্থায় পড়ার আগে সরকারকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের স্বার্থন্বেষী মহলের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের দিকেও যেতে হবে।
যেহেতু নির্বাচনের আগে এখন আর সরকারের পক্ষে বড় কিছু করা সম্ভব নয়। তাই এ সময়ে সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন বা দেড় হাজার কোটি ডলারের নিচে নামতে দেওয়া যাবে না। তবে স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থার পাশাপাশি নির্বাচন–পরবর্তী সংস্কারগুলোর বিষয়ে এখনই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে সংস্কারের জন্য এখনই তৈরি করতে হবে। এখন আর সংস্কারের স্বপ্ন দেখিয়ে লাভ হবে না, নিতে হবে সত্যিকারের পদক্ষেপ।
আমরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের দেওয়া মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য বা শর্ত মিস করেছি। জ্বালানির দামও নির্ধারণ করতে পারিনি। ফলে কিস্তির অর্থ নিয়ে শঙ্কা আছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আমদানির ওপর আর কড়াকড়ি আরোপ করা ঠিক হবে না। তাতে সরবরাহ পরিস্থিতিতে সংকট দেখা দিতে পারে। ডলারের ভিন্ন ভিন্ন দাম তুলে দিয়ে বাজারভিত্তিক একক দাম কার্যকর করতে হবে। প্রণোদনা দিয়ে প্রবাসী আয় বাড়ানোর চেষ্টা একটি ব্যর্থ উদ্যোগ। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে কিছু অর্থের অপচয় করা হচ্ছে।
অর্থনীতির বর্তমান সংকট এক দিনে তৈরি হয়নি। আর এটি এখন আর নির্দিষ্ট খাতেও সীমাবদ্ধ নেই। সব খাতে এ সংকট ছড়িয়ে পড়েছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ছিল না; বরং তা নিম্নমুখী ছিল। আমরা তাই বলেছিলাম, রাজস্ব আদায়ের এ ঘাটতি একসময় সরকারকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলবে। সেটি এখন দেখছি। সরকারের পক্ষে এখন তাই বড় ধরনের কিছু করা সম্ভব না। ঋণ করে হয়তো কিছুদূর যাওয়া যাবে, কিন্তু বহুদূর যাওয়া সম্ভব না।
অর্থনীতি গত দুই দশকে যত বড় হয়েছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে আর্থিক খাতের যত বড় হওয়ার কথা ছিল, সেটি হয়নি; বরং আরও সংকুচিত হয়ে গেছে। ব্যাংক খাতের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা বেড়েছে; কিন্তু এ খাতের গভীরতা বাড়েনি। বন্ড বাজারের কোনো উন্নয়ন হয়নি। শেয়ারবাজার এমনিতেই দুর্বল ছিল, এখন ফ্লোর প্রাইস দিয়ে সেটিকে বসিয়ে দিয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগে স্থবিরতা ও কর্মসংস্থানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। চাকরির বাজার বলতে গেলে নেই।
আগে সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কিছুটা হলেও ভালো ছিল। তাই আমরা দেখেছি, বাজেট ঘাটতি ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাখা যেত, কিন্তু এখন কিছুই সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের খরচ বেশি অপ্রয়োজনীয় খাতে। প্রয়োজনীয় খাতে সরকারের ব্যয়ের সক্ষমতা কমে গেছে। সরকারের ব্যয় এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যেটা এখন আর কমানো সম্ভব না। আবার রাজস্ব আয় বাড়িয়েও তা মোকাবিলা করা যাবে না।
সরকারের অবসরভোগীদের পেনশনের পেছনে এখন লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এটা নিয়েও ভাবতে হবে নতুন করে। ব্যাংক খাতে সংস্কার করতেই হবে, এটির আর কোনো বিকল্প নেই। ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ এবং অধিগ্রহণের ব্যবস্থা চালু করা দরকার। এর বাইরে টাকা দিয়ে ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগে কোনো লাভ হবে না।