সবচেয়ে বেশি খাদ্য মূল্যস্ফীতি জিম্বাবুয়েতে

মূল্যস্ফীতি
প্রতীকী ছবি

মূল্যস্ফীতি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ। মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে। ফলে বিশ্বজুড়ে একধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

মূল্যস্ফীতির মধ্যে আবার খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। কারণ, নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য ব্যয় অন্যান্য ব্যয়ের চেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের অনেক দেশেই এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের বেশি। এমনকি উন্নত দেশের মানুষও উচ্চ খাদ্য মূল্যের কারণে হিমশিম খাচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই–সেপ্টেম্বর সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি ছিল আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়েতে—৬৮ শতাংশ। এরপর লেবানন, ইরান ও হাঙ্গেরিতে তা ছিল যথাক্রমে ৩৬, ৩২ ও ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে অক্টোবর মাসে উন্নত দেশ যুক্তরাজ্যের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। সেখানকার মানুষ খাদ্যের উচ্চ দাম পোষাতে পারছেন না, এমন খবর অনেক দিন ধরেই সে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, জুন–সেপ্টেম্বর সময়ে বিশ্বের প্রায় সব নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়তি ছিল। নিম্ন আয়ের ৮৪ শতাংশ, নিম্নমধ্যম আয়ের ৮৯ ও উচ্চমধ্যম আয়ের ৯৩ শতাংশ দেশে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের ওপরে। অনেক দেশেই তা ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া ৮৭ শতাংশ উচ্চ আয়ের দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বাড়তি।

এদিকে দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো গড়ে মোট খরচের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ খাদ্যের পেছনে খরচ করে। গ্রামীণ প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তা ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বিশ্বের সবখানেই বিষয়টি কমবেশি এ রকম। অর্থাৎ প্রান্তিক মানুষের খাদ্য ব্যয় বেশি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের মানুষও খাদ্য ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই পাত থেকে খাবারের পরিমাণ কমাচ্ছেন।

২০২১ সালের শেষ দিকে যখন সারা বিশ্ব থেকে কোভিডজনিত বিধিনিষেধ উঠে গেল, তখন থেকেই মূল্যস্পীতির সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। এ বছরের শুরুতে রাশিয়া–ইউক্রেনে হামলা শুরু করলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে শুরু করে।

বিশ্বের বৃহত্তম গম উৎপাদক দেশ হচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেন কয়েক মাস গম রপ্তানি করতে পারেনি। ফলে গমের দাম বাংলাদেশসহ বিশ্বের সবখানেই অনেকটা বেড়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধের কারণে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বেড়েছে।

সেই সঙ্গে চলতি বছর বিশ্বের প্রায় সবখানেই প্রচণ্ড গরম পড়ে। প্রচণ্ড গরমে শুধু বাংলাদেশ ভুগেছে তা নয়, সারা বিশ্বই ভুগেছে। পৃথিবীটা জ্বলন্ত উনুনের মতো হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘মানবজাতি একযোগে আত্মহত্যার পথে এগিয়ে যাচ্ছে।’

গুতেরেস জলবায়ু বিপর্যয় রোধে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শিল্প সভ্যতা ও ভোগী জীবনযাপনকারী দেশগুলোর চরম অবহেলার প্রতি ইঙ্গিত করে কথাগুলো বলছিলেন।

জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে বন্যা, খরা, ঝড়, দাবানল বাড়ছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দুনিয়ার মানবজাতির অর্ধেকের বেশি চরম বিপদে আছে। বাংলাদেশের উপকূল সমুদ্রের তলায় ডুবে যাবে বলে সতর্কবাণী জারি রয়েছে কয়েক দশক ধরে।

জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের অভ্যাস বদলাতে না পারলে কোনো দেশই জলবায়ু বিপর্যয়ের অভিঘাত থেকে বাঁচবে না। গুতেরেস যখন গত জুলাই মাসে এসব কথা বলেন, তখন প্রচণ্ড দাবদাহে ইউরোপের বড় অংশ পুড়ছে। যুক্তরাজ্যে তাপমাত্রা রেকর্ড ৪০ কিংবা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠে যায়। দাবদাহের ফলে ফ্রান্স, স্পেনে দাবানল হয়। ইউরোপের পাশাপাশি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় দাবানল জ্বলছে। দাবদাহ বয়ে গেছে বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ বছর খাদ্য উৎপাদন অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে।

সেই সঙ্গে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে ইউরোপ ও আমেরিকা যে পথে হাঁটছে, তাতে গ্যাসভিত্তিক সার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তার জেরে এ বছর খাদ্য উৎপাদন আরেকবার মার খেয়েছে। ফলে এ বছর উচ্চ মূল্যে খাবার পাওয়া গেলেও আগামী বছর খাদ্যস্বল্পতা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

খাদ্য গ্রহণ কমলে কী সমস্যা

মূল্যস্ফীতি বা বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়লে মানুষ প্রথমত খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। মূলত আমিষের পরিমাণ কমে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। প্রয়োজনীয় পুষ্টি না পেলে শিশুদের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ভবিষ্যতে তাদের কর্মদক্ষতা কমে যায়।

শরীর সুস্থ ও অটুট রাখার জন্য আমিষ খুবই জরুরি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ খানা আয় ব্যয় জরিপে দেখা গেছে,  বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক মাথাপিছু ৬৩ দশমিক ৮০ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করে বিভিন্ন খাদ্যের মাধ্যমে। আমিষ গ্রহণের পরিমাণ গ্রামের মানুষের চেয়ে শহরের মানুষের মধ্যে কিছুটা বেশি। আমিষের প্রধান উৎস হচ্ছে চাল বা গম। ৩০ গ্রামের বেশি আমিষ আসছে এ উৎস থেকে। কিন্তু পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, মাছ, মাংস থেকে যে আমিষ পাওয়া যায়, তা শরীরের জন্য বেশি উপকারী।

কিন্তু মাত্র ২০ শতাংশ আমিষ আসে এই উৎস থেকে। এটা ছিল ২০১৬ সালের খানা আয় ব্যয় জরিপের পরিসংখ্যান। এর মধ্যে কোভিড ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের জোড়া ধাক্কায় পরিস্থিতির কতটা অবনতি হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। কোভিডের ধাক্কার পর মানুষ যখন আগের অবস্থায় ফিরছিল, তখন যুদ্ধের ধাক্কায় তা ব্যাহত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের উল্লিখিত প্রতিবেদন বলছে, আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা থাকবে। মূল্যস্ফীতিও থাকবে বাড়তি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, তীব্র খাদ্যসংকট কাটিয়ে উঠতে বিশ্বের অন্তত ৫৩টি দেশের ২২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন হবে। ফলে বিশ্বের অনেক মানুষের রাতের বেলা ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে যাবে। তাদের করোটিতে শিস কেটে যাবে ক্ষুধার বাতাস।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই খাদ্যসংকট মানবজাতিকে বড় পরীক্ষার মুখে ফেলে দেবে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে একযোগে এই সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে।