এনবিআরে (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) আন্দোলন তো আপাতত শেষ। এখন আপনার আহ্বান ও বার্তা কী।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: আশা করছি, সবাই এখন মনোযোগ দিয়ে কাজ করবেন। সবার বোঝা উচিত যে এনবিআরের কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা রাষ্ট্রের কাজ। সরকারের বদল হতে পারে। কিন্তু রাজস্ব সংগ্রহের কাজ তো ঠিক রাখতে হবে। এনবিআরে কাজ বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন করা মোটেই ঠিক হয়নি। তাঁরা কথা বলতে পারতেন। তাঁদের যে ডাকা হয়নি, তা তো নয়। অথচ শেষ দিকে তাঁরা কী চাইলেন? সরাসরি এনবিআর চেয়ারম্যানকে সরানোর দাবি করলেন।
চেয়ারম্যানকে সরানোর বিষয়টি তো পরে এসেছে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: তা এসেছে। আগে তো এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে যে দুটি বিভাগ করে অধ্যাদেশ জারি হলো, তার বিরোধিতা করেছে। বারবার বলেছি এর বিকল্প নেই। এ-ও বলা হয়েছে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই বিভাগ দুটির দায়িত্বে আসবেন। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তো তাঁরাই। ফলে তাঁদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। আর চেয়ারম্যানকে তো সরানো যায়-ই। এক চেয়ারম্যান যাবেন তো আরেকজন আসবেন। এতে লাভ কী? তাঁদের দাবির মুখে চেয়ারম্যানকে কেন সরাব?
রুলস অব বিজনেস বদলিয়েই তো দুটি বিভাগ করা যেত, এ জন্য অধ্যাদেশ জারির দরকার ছিল?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: দরকার ছিল। কারণ, রুলস অব বিজনেস বদলিয়ে এটা করা যেত না। এতে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। সিদ্ধান্তের জন্য পরে আবার মন্ত্রণালয়ের কাছেই আসতে হয়। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ক্ষেত্রে অনেক নেতিবাচক অভিজ্ঞতা আছে। আর বিভাগ মানেই তো স্বাধীন। সচিব নিজেই অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এ সুযোগ তাঁরা কেন নেবেন না?
এনবিআরের কিছু কর্মকর্তার বদলি এবং বদলির সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবি কেন আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে গেল?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: এটা তো আমারও প্রশ্ন। চার থেকে পাঁচজনের বদলি হয়েছে। এ ধরনের বদলির বিষয় তো আমার পর্যায়ে আসে না। অথচ কী দেখলাম? টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে সরকারি আদেশ ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। কী ঔদ্ধত্য!
আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম কতটা বিঘ্নিত হয়েছে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: ভালোই বিঘ্নিত হয়েছে। শুধু কি তাই? বাজেটের সময় ছিল এ আন্দোলন। অথচ এ সময়ে কত কাজ! ৩১ জুলাই পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। তাঁরা শোনেননি, কোনো তোয়াক্কাই করেননি। অতীতে কোনো দপ্তরে এ ধরনের কাণ্ড ঘটেনি। একটা অবশ্য ঘটেছিল। ওই যে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে প্রেসক্লাবের সামনে তৈরি করা হয়েছিল জনতার মঞ্চ। তা-ও তো ওই সময় কাজকর্ম বন্ধ করেননি কেউ।
আন্দোলনের এই সময়টিতে ব্যবসায়ী সমাজ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানালেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্যবসায়ীরা বলছিলেন, তাঁদের দেওয়া করের টাকায় যাঁরা চলেন, তাঁরাই ব্যবসায়ীদের বিপদে ফেলছেন। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল বলে তাঁরা বারবার হতাশা ব্যক্ত করেছেন। আমরা আন্দোলন বন্ধ করে এনবিআরের কর্মকর্তাদের আলোচনা করার কথা বলে যাচ্ছিলাম।
আলোচনা তো হয়েছেও।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: হয়েছে। কিন্তু তাঁরা তো কোনো কথাই শুনতে রাজি নন। আর আলোচনা একটা হয়েছে, দুইটা হয়েছে, আরও হতে পারত।
মূল বিষয় তো ছিল অধ্যাদেশ জারি।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: অধ্যাদেশ করার মূল কথাটাই আসি। নীতি যিনি করেন, বাস্তবায়নও তিনিই করবেন, এটা আসলে হয় না। আজই এক ব্যবসায়ী আমাকে জানালেন, এনবিআরের এক কর্মকর্তা এমন একটি কর ধার্য করলেন, দেখে তিনি ‘হা’ হয়ে গেছেন। কর্মকর্তা নাকি এ-ও বলেছেন, এ টাকা দিতেই হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেটা হয়, এনবিআরের কর্মকর্তা করের টাকা কমিয়ে দিতে পারেন। তাহলে কী দাঁড়াল বিষয়টা? যিনি কর ধার্য করলেন, তিনিই আবার তা কমিয়ে দিলেন। অনেক ক্ষেত্রে একধরনের ভাগাভাগি হয়। এতে বঞ্চিত হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার। তবে সবাই যে এমন, তা নয়। এসব কারণেই দুই বিভাগ আলাদা হওয়া জরুরি।
কিন্তু আন্দোলন দমাতে আন্দোলনকারী কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে অনুসন্ধান করার উদাহরণটি কি ভালো হলো?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: এ বিষয়ে দুদককে সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। এটা কাকতালীয় হতে পারে। দুদক নিজের মতো করেই এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুসন্ধান করছে। আর দুদকের কাছে যে কোনো তথ্য নেই, এমন তো না। সংস্থাটির তো নিজস্ব পারসেপশন আছে। কে, কী রকম, চাইলেই তা জানা সম্ভব। যদিও অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই অনুসন্ধানের কাজ করে দুদক।
ঋণ কর্মসূচির শর্ত হিসেবে কর-জিডিপি হার বছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধির একটা লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল)। এ হার এখন ৮ শতাংশের ঘরে আছে। হার যদি না বাড়ে, আইএমএফ কিছু বলবে না?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: বলবে না মানে? আগামী অক্টোবরেই আইএমএফের দল আসছে পর্যালোচনা করতে। ইতিমধ্যে তারা চিঠি দিয়েছে। তখন তো জবাব দিতেই হবে আমাদের। কী আর করব। আইএমএফকে আমরা পুরো পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলব।
দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে ছাড় করার পর গত ২৯ জুন বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে আইএমএফ বলেছে, তারা মুদ্রা বিনিময় হার পরিপূর্ণভাবে বাজারভিত্তিক চায়।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: কাজটা কঠিন। তবে মনে রাখতে হবে যে জাপান, চীন ইত্যাদি দেশও ম্যানেজড মুদ্রা বিনিময় হারই অনুসরণ করে।
সরকারি কর্মচারীদেরও তো আরেকটা আন্দোলন চলছিল। এটা কি থেমেছে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: মোটামুটি শেষ। আমরা বলেছি যে তাদের আপত্তিগুলো আমলে নেওয়া হবে। আমরাও চাই এ অধ্যাদেশের যেন অপব্যবহার না হয়।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। শেয়ারবাজারটা কি এমন মৃতপ্রায় অবস্থাতেই থাকবে? কী করছে সরকার?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: কী বলব, ১৫ বছরে শেয়ারবাজারের এমন দুর্দশা হয়েছে যে একে ঠিক করতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফ্লোর প্রাইস দিয়েছিল তখনকার বিএসইসি (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন)। এটা তো কোনো কাজ হলো না। বাজারে ঝুঁকি থাকবেই। বিশ্বজুড়েই তা রয়েছে। ঝুঁকি বেশি যেখানে মুনাফাও সেখানে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। বিনিয়োগকারীদের নিজ দায়িত্বে এ বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে। এবারের বাজেটে তো শেয়ারবাজারে কিছুটা কর-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ভালো সরকারি কোম্পানি বাজারে আনার চেষ্টা করছি। এ বাজারের ভবিষ্যৎ ভালো বলেই আশা করছি।
পাচার অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাস্তবে এগুলো ফেরত আনা সম্ভব?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: কিছু কিছু আসবে। কয়েকটি দেশের সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স (এমএলএ) করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমি আশাবাদী।
বাজেটের পর প্রায় প্রতিবারই ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য বিদেশ ভ্রমণ, নতুন গাড়ি কেনা ইত্যাদি নিরুৎসাহিত করতে প্রজ্ঞাপন জারি করতে দেখা যায়। এবারও কি সে রকম কিছু হবে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: অবশ্যই। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার শুরু থেকেই সব ধরনের ব্যয় সাশ্রয়ের পক্ষে।
বিনিয়োগ নিয়ে যে এত বড় সম্মেলন হয়ে গেল, বিনিয়োগ তো বাড়ছে না।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: বিনিয়োগ না বাড়ার পেছনে সমস্যা তো আছেই। সমস্যা তো বহু দিনের। হুট করে তো বিনিয়োগ বাড়বে না। তবে আমরা বাধাগুলো দূর করার চেষ্টা করছি। উদ্যোগ নিয়েছি যেন এক জায়গা থেকে প্রায় সব সেবা দেওয়া যায়। এখানে লম্বা সময়ের নীতি পদক্ষেপের ব্যাপার আছে। আর দেশি বিনিয়োগ বাড়লেই না বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। উভয় ধরনের বিনিয়োগ বৃদ্ধির যথাযথ পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য। আইনি ঝামেলাও ঠিক করে দেওয়ার কাজ চলছে।
খেলাপি ঋণ ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেল।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: হ্যাঁ। প্রকৃত হিসাব তো বের হচ্ছে এখন। আগে এ হিসাব লুকিয়ে রাখার বা ধামাচাপা দেওয়ার একটা প্রবণতা ছিল।
চারটি অর্থঋণ আদালতে ৩৮ হাজার মামলা আছে। আরও তিনটি অর্থঋণ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হলেও অবকাঠামো তৈরি না করায় তারা কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: এটা ঠিক। দেখি, আইন মন্ত্রণালয়কে আমি এ ব্যাপারে দ্রুততম সময়ে পদক্ষেপ নিতে বলব। মামলাগুলো শেষ করতে বর্তমান অর্থঋণ আদালতগুলোকে গতিশীল হতে হবে। নতুন অর্থঋণ আদালতগুলোর কার্যক্রমও ভালোভাবে শুরু হওয়া দরকার।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।